গল্প

ছুটুর তৈরি স্মৃতিসৌধ

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। তার ডাকে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাস ধরে যুদ্ধ হয়। তারপর আমরা বিজয় লাভ করি। লাখ লাখ বাঙালি আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন দেন। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন আমরা সব সময় তাদের স্মরণ করব।

প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

নুরুল ইসলাম বাবুল
সকালবেলা। উঠোনের একপাশে ডালিমগাছ। ছাতার মতো ডালপালা গাছটির। গাছের নিচে চেয়ার পেতে আরাম করে বসে আছেন ছুটুর দাদা। হাতে গতকালের খবরের কাগজ। পাশে মাদুর পেতে বসে আছে ছুটু। আজ তার স্কুল ছুটি। পড়া নেই। তবে অনেক কাজ তার হাতে। আজ সে নিজে নিজে স্মৃতিসৌধ তৈরি করবে। কয়েকদিন আগে মেজখালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল ছুটু। সঙ্গে তার মা-বাবাও ছিলেন। মেজখালা থাকেন ঢাকার সাভারে। সেখানে আছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এক বিকালে তারা দেখতে গিয়েছিল সেই স্মৃতিসৌধ। শহীদদের স্মরণ করে ফুল দিয়েছিল সেখানে। খালাতো ভাই মাহিন ছুটুর সমবয়সি। দুজনই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্মৃতিসৌধ দেখে আসার পর মাহিন বলেছিল, জানিস, ছুটু, আমি নিজে নিজে স্মৃতিসৌধ বানাতে পারি। ছুটু বলেছিল, কীভাবে? তারপর মাহিন ককসিট কেটে কেটে স্মৃতিসৌধ বানিয়ে দেখাল। ছুটু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিল সেটা। আজকে নিজে তৈরি করে দাদা-দাদি, মা-বাবাকে দেখাবে। ইতোমধ্যে বাবাকে দিয়ে ককসিট আনিয়েছে সে। আঁঠা এনেছে। আলপিন এনেছে। মায়ের কাছে কাঁচি ছিল। সবকিছু নিয়ে মাদুর পেতে বসেছে ছুটু। দাদা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে জিজ্ঞাস করলেন, কী করছ, ছুটু? ছুটু কোনো কথা বলল না। হয়তো ভালো করে শুনতে পায়নি সে। তার মনোযোগ স্মৃতিসৌধ তৈরি করার কাজে। দাদা আবারও জিজ্ঞাস করলেন, কী করছ, ছুটু? এবার জবাব দিল ছুটু। বলল, আমি কাজ করছি, দাদু। দাদা বললেন, কী কাজ? ছুটু আগের মতোই বলল, আমি স্মৃতিসৌধ বানাচ্ছি, দাদু। দাদা এবার মুখ তুলে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, স্মৃতিসৌধ বানাচ্ছ? ছুটু বলল, হঁ্যা, দাদু। দাদা ভালো করে খেয়াল করলেন। মাদুরের মাঝখানে বসে আছে ছুটু। চারিদিকে ছড়ানো-ছিটানো ককসিট, আঁঠার কৌটা, আলপিন, কাঁচি, রঙিন কাগজসহ আরও কত কি! ছুটু এটা নিচ্ছে, সেটা নিচ্ছে। কাজে খুব মনোযোগ তার। দাদা হাসতে লাগলেন। আরও কিছু সময় দেখে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ায় মন দিলেন। অনেক সময় ধরে ককসিট কাটাকাটি করল ছুটু। কিছু সময় ভাবল। কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করল। মাহিন কীভাবে স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছিল, তা নিয়ে আরও চিন্তা করল। এক সময় তার মুখে হাসি ফুটল। ও মনে পড়েছে- বলে মাথা নাড়ল। আস্তে আস্তে সুন্দর একটা স্মৃতিসৌধ বানিয়ে ফেলল। ছুটু আনন্দিত হলো। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দাদাকে ডাকল, দাদু, দেখ, আমার স্মৃতিসৌধ। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন দাদা। ওহ! চমৎকার একটা স্মৃতিসৌধ। দাদা জোরে হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, এটা তুমি বানালে? ছুটু বিজয়ের সুরে বলল, হঁ্যা, তোমার কাছে বসেই তো বানালাম। দাদা এবার ছোটোদের মতো হইচই করতে লাগলেন। ছুটুর দাদা, মাকে জোরে জোরে ডাকলেন, তোমরা কোথায়? এসে দেখে যাও, আমাদের ছুটুসোনা কি করেছে। দাদি এলেন। মা এলেন। বাইরের কাজ শেষ করে ঠিক তখনই ছুটুর বাবাও এলেন। প্রথমে দাদি বললেন, কী করেছে ছুটু? মা বললেন, আমার ছুটুমণির কী হয়েছে? বাবা এসেই দেখে ফেলেছেন ছুটুর স্মৃতিসৌধ। তাই তিনি বললেন, তোমরা, এখনো দেখনি? দাদি ও মা একসঙ্গে বললেন, কী? এবার দাদা বললেন, ওই যে, মাদুরের ওপরে দেখো। দাদি দেখলেন। মা দেখলেন। বাবা হাতে নিয়ে দেখলেন। দাদি খুশি হয়ে বললেন, এটা আমাদের ছুটু বানিয়েছে। দাদা আনন্দ নিয়ে বললেন, তবে এমনি কি আর তোমাদের ডেকে এনেছি। এবার ছুটু বলতে লাগল, এখন তোমরা ফুল নিয়ে এসো। স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে হবে। দাদা বললেন, তাই নাকি, দাদুভাই। ছুটু বলল, হঁ্যা, তোমরা জানো না? আমাদের দেশ এক সময় পরাধীন ছিল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। তার ডাকে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাস ধরে যুদ্ধ হয়। তারপর আমরা বিজয় লাভ করি। লাখ লাখ বাঙালি আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন দেন। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন আমরা সব সময় তাদের স্মরণ করব। শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধ নিবেদন করব। বাবা বললেন, তুমি এসব জানো? ছুটু বলল, হঁ্যা, স্কুলে এসব আমরা শিখেছি। আরও শিখেছি, ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এ দিনগুলোতে আমরা শহীদদের বিশেষভাবে স্মরণ করি। নিজেদের বাগান থেকে একগাদা ফুল নিয়ে হাজির হলো ছুটুর দাদি। একটা একটা করে সবার হাতে দিলেন তিনি। সবাই দাঁড়ালেন স্মৃতিসৌধের সামনে। শ্রদ্ধায় অবনত সবাই। প্রথমে ছুটু তার হাতের ফুলটা রাখল নিজের হাতে বানানো স্মৃতিসৌধের সামনে। দাদা রাখলেন। দাদি রাখলেন। বাবা ও মা রাখলেন। ফুলে ফুলে ভরে গেল ছুটুর তৈরি স্মৃতিসৌধ। আনন্দে ভীষণ কান্না পেল ছুটুর।