গল্প

আকাশ বৃক্ষ

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

নূরে জান্নাত
গাছটির অদ্ভুত ছাল বাকল। রঙটাও পৃথিবীতে থাকা অন্যান্য চেনা গাছের মতো না। গাছটির মাথার উপর এক টুকরো আকাশও আছে। এমন অদ্ভুত গাছ আগে না দেখায় অবাক হয় মিরিয়াম। আগ্রহ নিয়ে গাছটিকে স্পর্শ করতে গেলে গাছটি লাফ দিয়ে সরে যায়। মিরিয়াম আবার স্পর্শ করতে নেয়। গাছটি এবারও সরে যায়। মিরিয়াম এবার খুব রেগে যায়। বকতে শুরু করে গাছকে... তুমি জানো? আমি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি? আমার রোল এক নয় তবুও ক্লাশে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সবাই আমার কথা শোনে; কারণ আমি ক্লাস ক্যাপ্টেনও। আর তুমি একটা গাছ হয়ে আমার কথা কেন শুনছো না? অদ্ভুত গাছটি এবার হোহো করে হেসে উঠে বলে... তুমি কখন কথা বললে মিষ্টি মেয়ে? মিরিয়াম আরো রেগে গিয়ে বলে- মনে মনে বলেছি থামতে। তুমিওতো মনে মনে বললে- আমার পেছনে এসো, আমাকে তাড়া করো, আমাকে ছুঁয়ে দাও। অদ্ভুত গাছটি অবাক হয়ে তার কপাল কুচকে বলে.. তুমি গাছেদের ভাষা বোঝ? মিরিয়াম কোমড়ে হাত রেখে পাকা বুড়ির মতো বলে- কেন বুঝব না! ইরানের দামেস্ক শহরে জন্ম নিয়েছিলাম বলে? অদ্ভুত গাছ বলল, না না, তা নয়। তবে.. তোমার বয়সি সবাই এখন স্মার্ট ফোন, কার্টুন, আর ভিডিও গেম ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ তুমি কিনা বলছ তুমি গাছেদের ভাষা বোঝ? মিরিয়াম হেসে ওঠে.. বাপরে.. কেন বুঝব না? আমার তো গাছেদের সঙ্গেই বাস। তুমি চলো আমার সঙ্গে। দেখবে আমার কত সুন্দর বাগান আছে- সেখানে সুন্দর সুন্দর গাছ আছে। আমি গাছদের চুল বেঁধে দিই- গোসল করিয়ে দিই, খাবার খাইয়ে দিই। অদ্ভুত গাছ আরো অবাক হয়ে বলে ওঠে... চুল? খাবার? গোসল, খাওয়া এসব তো মানুষের হয়। তোমার কাছেই নতুন কিছু শুনলাম। আচ্ছা মিরিয়াম, তুমিতো বললে তোমার ওখানে সব গাছই সুন্দর! কিন্তু আমিতো অসুন্দর। আমার ফুল ফল হয় না- তবে বীজ হয়। দেখ না গাটাও কেমন খসখসে! এজন্য আমাকে কেটে ফেলার পাঁয়তারা করছিল- তাইতো আমি বন থেকে উড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে। মিরিয়াম প্রশ্ন করে গাছকে- তুমি উড়তে পারো? হঁ্যা। আমাকে চিনতে আগে থেকে? হঁ্যা। একটা পাখি তোমার বাগানে থাকত, সে একদিন ঘুরতে যায় সুন্দরবনে। কোনো গাছ তাকে আশ্রয় দেয় না। আমি তাকে আশ্রয় দিলে সে উপকারের প্রতিদান হিসেবে তোমার ঠিকানা দেয়। তুমি কি আমার মতো অসুন্দর গাছকে তোমার বাগানে নেবে? নেব। গাছ কখনো অসুন্দর হয় না। তার আগে জানা দরকার... তোমার নাম কি? আকাশ বৃক্ষ। এজন্য বুঝি তোমার মাথায় এক টুকরো আকাশ? তেমন না- তবে ভালো কাজ করা ভালো মানুষের দেখা পেলে আমার মাথায় এমন এক টুকরো আকাশ গজায়। যার জন্য আমি আকাশ বৃক্ষ। তুমি মেয়ে না ছেলে গাছ? আমি মা গাছ। মিরিয়ামের সঙ্গে আকাশ বৃক্ষ হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে..? আমার মাথায় একটা কথা ঘুর পাক খাচ্ছে মিরিয়াম। কি? এই সামাজিক অবক্ষয়ের করুণ সময়ে, যেখানে সবাই গাছ নিধন করছে.. ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস নিয়ে মাতছে সেখানে তুমি বৃক্ষপ্রেমী কীভাবে হলে? মিরিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ছোট বেলায় আমার বাবা মাকে দেখেছি গাছের উপরে ঘরে বানিয়ে থাকতে। ঘরটা অদ্ভুত সুন্দর লাগত গাছটির জন্য। আমাকেও গাছের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয় মা-বাবা, যত্ন নিতে শেখায়। আমি তখন কথা বলতে পারতাম না। মা-বাবা যা বলেছিল সব বুঝতাম, মনেও আছে এখন। যখন আমি হাঁটতে শিখি তখন আমরা যে গাছের গাঁয়ে ঘর বানিয়ে থাকতাম সে গাছ মরে যায়। গাছটি মরে যাওয়ার আগে সবার আড়ালে আমার হাতের মধ্যে কিছু বীজ দিয়ে গিয়েছিল তার হাত থেকে। গাছের হাতটা আমার দাদিমার হাতের মতো দেখতে ছিল। আমার খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। তার পর থেকে আমি গাছ ভালোবাসি। মিরিয়ামের চোখ ছল ছল- যা দেখে আকাশ বৃক্ষও কেঁদে ফেলে। মিরিয়াকে আকাশ বৃক্ষ চোখ বন্ধ করতে বলে। মিরিয়াম কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পর মাথায় ভারী কিছু একটা অনুভব করে এবং পিঠেও মনে হয় কিছু একটা হচ্ছে। চোখ খুলে দেখে মিরিয়াম একটি ছোট্ট সবুজ গাছ হয়ে গেছে, তার মাথায় ছোট্ট এক টুকরো আকাশ, পিঠে দুটো পাখা। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোটবেলার সেই গাছটি, যে গাছটির মৃতু্যর পর মিরিয়াম খুব কেঁদেছিল। মিরিয়াম এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। আকাশ বৃক্ষ এবং মিরিয়াম এক সঙ্গে বনবনান্তরে আকাশে বাতাসে উড়তে থাকে এবং যেখানে গাছ নেই সেব জায়গা সবুজ বানিয়ে ফেলেতে থাকে।