বুবলির বৈশাখ

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মিতুল সাইফ
কালো কালো তুলো তুলো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। বুবলি বাবার হাত শক্ত করে ধরে, দ্রম্নত পা চালায়। বাতাসের শন শন শব্দে গাছপালা তোলপাড় হচ্ছে। বাবা আবুরালির মুখে কোনো কথা নেই, তবে খুব চিন্তিত; মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। : বাবা বাবা মেলা অনেক দূর? : না মা, এই তো এলো বলে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে? : হু, : তুমি আমার কাঁধে চড়ে বসো, এই আমি নিচু হচ্ছি। : না না বাবা, আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। \হবাবা শোনে না, বুবলিকে কাঁধে তুলে নেয়। তারপর আবার দ্রম্নত পা চালায়। লিচুগাছের নিচ দিয়ে সরু মেঠো পথ ধরে আবুরালি ছুটে চলে গোয়াল পাড়ার বৈশাখি মেলায়। পাপড় ভাজা আর মিষ্টির গন্ধ নাকে এসে লাগে। বাঁশি আর জন কোলাহলে গমগম করছে চারদিক। বাবার কষ্ট হচ্ছে বুঝে কাঁধ থেকে নেমে আসে বুবলি। সেও সমান তালে পা চালায় বাবার সঙ্গে। আবুরালির মুদি দোকান আছে গ্রামে। এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। অভাবের সংসারে মেয়েটাই তার অনন্য সুখের উৎস, বড় আদরের। তার বায়না রাখতে আজ বিকালে দোকান বন্ধ রেখে মেলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে বেলা থাকতে থাকতেই। কিন্তু হঠাৎ আকাশ কালো। ঝড় আসবে হয়তো। কুন্ডলী পাকিয়ে ধুলো উড়ছে। এলোপাতাড়ি বাতাস আর ধুলো মেখে অবশেষে তারা পৌঁছে যায় মেলায়। তখন নাগরদোলার চাকা থেমে গেছে। বাড়ি ফেরার জন্য সবাই তড়িঘড়ি ছুটছে। বাবা দ্রম্নত কিনে নেয় মেয়ের মাটির পুতুল, বাঁশি, পাখা, পাপড়, মিষ্টি আর একটা রঙিন ছাতা। একটু বাদেই শুরু হয় বাতাসের তান্ডব। প্রচন্ড ঝড় আর বৃষ্টি। দোকানগুলোর চটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সবাই ছুটতে থাকে। মুহূর্তেই জনশূন্য হয়ে যায় মেলার মাঠ। শুধু বৃষ্টি ভিজে ঝড় সয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়ে। বয়স সাত থেকে নয়ের মধ্যে। বুবলিকে নিয়ে বাবা একটা বড় দোকানের কার্নিশের নিচে কোনো রকমে আশ্রয় নিয়েছিল। বাচ্চা দুটোর জন্য খুব কষ্ট হলো বুবলির, বাবাকেও চিন্তিত দেখালো। ইতোমধ্যে ঝড় থেমেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে গড়গড়িয়ে। রঙিন ছাতাটা মেলে ধরে এগিয়ে যায় বুবলি, সঙ্গে সঙ্গে বাবাও পা বাড়ায়। : তোমরা এখানে কি খুঁজছো? তোমাদের বাড়ি কোথায়? ছেলেটা একটু বড়, আট থেকে নয় বছরের হবে। এগিয়ে এসে জবাব দেয়। : আমাদের পয়সা হারিয়ে গেছে। আমরা দুই ভাই বোন। আমি তমাল ও তুলি। থাকি চৌপারের স্কুলের ওই দিকে। : সঙ্গে কেউ আসেনি? : আমাদের সঙ্গে কেউ আসেনা। পয়সাটা পেলে কিছু কিনেই চলে যাবো ভেবেছিলাম। অনেক দিনের জমানো পয়সা। : তোমাদের মা, বাবা? : বাবা নেই। কখনো দেখিনি। মা হাঁটতে পারে না। মায়ের খুব অসুখ। বসে বসে দর্জির কাজ করে। তুলি তখন বৃষ্টিতে ভিজে ঠক ঠক করে কাঁপছে। ভেজা চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বুবলি তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। অনেক আদর করে দিল। সমস্ত খেলনা, মিষ্টি তুলির হাতে দিয়ে বলে- : একা একা যেতে পারবে? তমাল মাথা নেড়ে হঁ্যা জানালো। তার হাতে ছাতা, আর পাখা দিয়ে বলল, : পাখাটা মাকে দিও। \হচোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেল দুই ভাই বোন। বুবলি বাবার চোখে তাকিয়ে বলল.. : রাগ করেছ বাবা? বাবা চোখ মুছে বুবলিকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তখন ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে, চারদিকে খেলা করছে নতুন রোদ্দুর।