কালো ভূতের ভালো কান্ড

প্রকাশ | ১৮ মে ২০১৯, ০০:০০

মাহবুব এ রহমান
অনেকদিন পর লম্বা ছুটি পেয়েছে টুটুন। গ্রীষ্মকালীন ছুটি। অন্তত কয়েকদিনের জন্য হলেও পড়াশোনাকে গুডবাই জানাতে পারবে। টুটুনের অবশ্য এদিকে তেমন ভ্রম্নক্ষেপ নেই পড়াশোনার অতটা চাপ নেই তার। ২য় শ্রেণিতে পড়ছে টুটুন। আব্বু বিদেশে। বাসায় শুধু আম্মু আর ছোটোমামা। ছোটোমামা সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। নাম রঞ্জু। টুটুনের আব্বু বিদেশে থাকায় টুটুনদের বাসায়ই থাকেন ছোটোমামা। ইদানীং বড্ড পাঁজি হয়েছে টুটুন। পড়াশোনায় একদম মন নেই। আম্মু আর ছোটোমামার আদর পেয়ে মাথায় উঠেছে। তবে মাঝেমধ্যে আম্মুর একটি আধটু মিষ্টি বকুনি যে খায়না তা কিন্তু নয়! পড়ার সময় কার্টুন দেখতে আর গেম খেলতে দেখলে আম্মু রোজই বকেন। তবে ওসব তেমন একটা গায়ে মাখে না। আগেই আম্মুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। এবারের ছুটিতে দাদু আর নানুবাড়িতে বেড়াতে যাবে। টুটুনের আম্মু টুটুনদের স্কুলের শিক্ষক। সে সুবাদে মা-ছেলের ছুটিটাও একসঙ্গে। তিনিও ঠিক করলেন একসঙ্গে শ্বশুরবাড়ি এবং বাবার বাড়িটা বেড়িয়ে আসা যাবে। টুটুনের দাদুরা গ্রামেই থাকেন। আব্বু অনেক চেষ্টা করেও শহরে নিয়ে আসতে পারেননি। দাদুর একটাই কথা, এ গ্রাম এ বাড়ি ছাড়া আমার কোথাও মন বসে না। ছুটিটা গতকালই হয়েছে। এবার গ্রামে ফেরার পালা। প্রতিবারই বাড়ি ফেরার সময় কিছু কেনাকাটা করেন টুটুনের আম্মু। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সেবার নানা বাড়িতে যাওয়ার সময় মণির জন্য একটা দোলনা কিনে নিয়েছিল টুটুন। মণি টুটুনের একমাত্র মামাতো বোন। বড় মামার মেয়ে। দোলনা পেয়ে সেকি খুশি মণি। আনন্দে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিল সেদিন। বাইরে থেকে কেউ এলে দোলনাটা সবার আগে দেখাতো সে। মণিদের শোবার ঘরে দোলনাটা ঝুলিয়েছিলেন মণির আম্মু। দোলনায় দোল খেয়ে খেয়ে মায়ের কাছ থেকে বর্ণমালা শিখতো মণি। টুটুন ঠিক করেছে এবার মণির জন্য একটা স্কুলব্যাগ নেবে। সঙ্গে রংপেন্সিল আর ড্রয়িংবুকও। মণি স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে। মামানি বলেছেন মণি নাকি আঁকাআঁকিতে বেশ পটু। বিকেলেই আম্মু আর ছোটোমামার সঙ্গে কেনাকাটা সেরে ফেলে টুটুন। পরদিন ভোরে উঠে রওনা। গন্তব্য দাদুর বাড়ি। দাদুরা টুটুনদের আসার খবরটা আগেই পেয়েছিলেন। দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান তারা। স্টেশনে এগিয়ে নিতে আসেন ছোটচাচ্চু। অনেকদিন পর দাদি-দাদুর স্পর্শে ভীষণ আনন্দিত টুটুন। দাদুবাড়িতে দাদি-দাদু আর ছোটোচাচ্চু ছাড়া আর লোকজন নেই তেমন। টুটুনের সারাদিনের সাথী দাদু। তা ছাড়া ছোটচাচ্চুও কম সময় দেন না ওকে। রোজ বিকেলে মাঠে নিয়ে যান খেলতে। টুটুন বেশ ভালো ক্রিকেট খেলা জানে। কিন্তু গ্রামে ছেলেমেয়েরা কানামাছি, ভোঁদৌড় আর গোলস্নাছুটেই মেতে থাকে। অল্প সময়ে ওদের সঙ্গে মিশে যায় টুটুন। বেশ হই-হুলেস্নাড়ে কেটে যায় কদিন। টুটুনদের ছুটি আর বেশিদিন নেই। আম্মু সিদ্ধান্ত নিলেন টুটুনের নানাবাড়িতে কাটাবেন বাকি ছুটির দিনগুলো। প্রথমে মন খারাপ হলেও পরে বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে টুটুন। ছোট্ট মণিকে পেয়েও বেশ আনন্দিত। নানাবাড়িতে নানা-নানু, মামা, মণি আর মামানি। বেশ বড় বাড়ি। মামা নতুন করে বড় বাড়ি করেছেন। বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। পেছনে ছোট একটি ফলফলাদির বাগান। বাগানে আছে আম, লিচু, পেয়ারা, কাঁঠাল এবং আমড়া। তন্মধ্যে আমড়ার গাছটিই সবচেয়ে বড়। আমড়া ধরতেও শুরু করেছে। সেদিন বাজার থেকে ছোটোমাছ এনেছেন মামা। নানাভাই বললেন টক তরকারি খাবেন। তাই নানু আমড়াগাছ থেকে আমড়া পেড়ে নিয়ে আসেন। সেদিন বিকেলে নানুর সঙ্গে টুটুনও গিয়েছিল বাগানে। ওই রাতেই প্রচন্ড জ্বর ওঠে টুটুনের। দুদিন হয় জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই। মামা ডাক্তারকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ওষুধ পথ্য সেবনের পরও তেমন উন্নতি হয়নি। সে রাতে টুটুন স্বপ্ন দেখে তার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা কালো ছায়ামূর্তি। ঘরের ছাদের সঙ্গে লেগে যায় এমন অবস্থা। মুখেও মুখোশ পরা। দেখেই ভড়কে যায় টুটুন। চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না। ধীরে ধীরে ছায়ামূর্তিটি আসতে থাকে কাছে। ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে টুটুন। কতক্ষণ পর খেয়াল করে কেউ একজন মাথায় হাত বুলাচ্ছে। বেশ ঠান্ডা হাত। জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীরে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় অনেকটা সুখানুভূতি হয় টুটুনের? চোখ মেলে তাকায়। সামনে দাঁড়িয়ে সেই ছায়ামূর্তিটি। এখন অনেকটা দৃশ্যমান। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে টুটুন। এবার মুখ খোলে ছায়ামূর্তি। 'ভয় পেও না টুটুন। দুদিন থেকে তুমি অসুস্থ, তাই তোমাকে দেখতে এলাম। কোনো ক্ষতি করব না তোমার'। শেষ কথাটায় কিছুটা আশ্বস্ত হয় টুটুন। এবার উল্টো প্রশ্ন করে টুটুন- আপনি কে, এখানে এসেছেনই বা কেন? -আমার পরিচয় পেয়ে ভয় পাবেনা তো! কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে টুটুন উত্তরে বলে -না। ভয় পাবো না। -আমি ভূত। -ভূত! এখানে এসেছেন কেন? আসার কারণটা তো আগেই বলেছি। তুমি অসুস্থ তাই দেখতে আসা। ভয়ের কিছু নেই। তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। শুধুমাত্র অসুস্থতার খোঁজ নিতে এলাম। চিন্তা করো না। তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। কিছুটা অভয় পেয়ে টুটুন আবার বলে- আমি তো জানতাম ভূত-জিন এরা খুব খারাপ হয়। আপনি তো দেখি সম্পূর্ণ এর বিপরীত! -সবাই খারাপ হয় না। টুটুন মাথা নাড়ে। ভূত এবার বলতে শুরু করে.... শোনো আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে কিছু সদুপদেশ দিয়ে যাই। তুমি পড়াশোনায় বেশ ফাঁকি দাও। আম্মুর কথাও নাকি শোনো না মোটে। এসব একদম করতে নেই। মনে রেখ, বড়দের সব সময় মান্য করবে, তাদের কথামতো চলবে। ছোটোদের স্নেহ করবে। এবারও হঁ্যা সূচক মাথা নাড়লো টুটুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায় কালো ভূতটি। টুটুনের নড়াচড়ায় ঘুম ভাঙে টুটুনের আম্মুর। টুটুন বেশ কাঁপছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখেন জ্বর অনেকটা সেরে গেছে। ভাবেন, হয়তো কাঁপুনি দিয়ে জ্বরটা নেমেছে। কিন্তু হঠাৎ চোখ খোলে টুটুন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপ করে জড়িয়ে ধরে আম্মুকে। শুয়ে পড়ে আম্মুর বুকে। তখনও সমানতালে কাঁপছিল। এভাবেই একসময় আম্মুর কোলে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে সে। সকালে সবাইকে রাতের ঘটনাটি খুলে বলে। সব শোনে টুটুুনের আম্মু সিদ্ধান্ত নেন আর একটি দিনও এখানে থাকবেন না আর। ব্যাগ গুছিয়ে ধরেন শহরের পথ। কিন্তু টুটুন ভাবে ভূতটা তো খারাপ কিছুই বলেনি। আসলে আমার ভুলগুলোই শুধরাতে বলল। টুটুন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনো মায়ের অবাধ্য হবে না। পড়াশোনায়ও ফাঁকি দেবে না আর.....