শিশুতোষ গল্প

আমরা বাঁচতে চাই

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

জান্নাতুল ফেরদৌস
এ খন রাত। ডিম ফেটে বের হয়ে এলো ছোট্ট একটা কচ্ছপের বাচ্চা। চারপাশে তাকিয়ে দেখল বাচ্চাটি। চারদিকে বালু আর বালু। আর কোথা থেকে যেন বয়ে আসছে হুহু বাতাস। আরও ভালো করে তাকিয়ে বাচ্চাটি দেখল, চারদিকে আরও অনেক ডিম ফুটো করে বের হয়ে আসছে তারই মতো দেখতে আরও অনেকে। তারা সবাই দেখতে একই রকম। এই পরিবেশে ওরা সবাই নতুন। ডিমের খোলসের ভিতর ওরা ছিল শব্দহীন। ধুলা বাতাস, বালুময় ভূমি সবকিছুই ওদের কাছে অস্বস্তিকর লাগছে। হঠাৎ একটি কচ্ছপ শিশু সবার সামনে এগিয়ে একটা উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'সকলে শোনো, আমরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের এখন ছুটে যেতে হবে সাগরের দিকে। সাগরে আছে নোনা পানি। ওই পানি আমাদের স্বস্তি দেবে।' সব কচ্ছপ শিশুগুলো আস্তে আস্তে তাকে ঘিরে জড়ো হলো। আরেকটি কচ্ছপ শিশু এগিয়ে এসে বলল, 'তুমি এতকিছু জানলে কীভাবে?' 'কারণ আমাদের জন্মের সময় দিকনির্দেশনা দেয়ার কেউ থাকবে না। তাই আমাদের অভিভাবকরা আমাদের মধ্যে একজনকে দলনেতা নির্বাচন করেছেন। আর আমিই সেই দলনেতা। আমার ডিমের কাছে এসে অভিভাবকরা বলে গেছে, আমাদের করণীয় বিষয়।' 'তো দলনেতা এখন বলো, আমরা কী করব?' পেছন থেকে চিৎকার করে বলল আরেকটি কচ্ছপ শিশু। 'শোনো তারা আমাকে বলেছে, আকাশে চাঁদ থাকবে, যে আলো দিয়ে আমাদের পথ দেখাবে। আর তার আলোয় সাগরের পানি ঝলমল করবে। সেই পানিতে নামলেই আমরা আরাম পাব। আমাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেও আমাদের দেখা হবে সেখানে।' 'তাহলে আর দেরি করে কী লাভ? চলো আমরা এগিয়ে যাই। এই বালুতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে।' বলল আরেকটি কচ্ছপ ছানা। দলনেতা বলল- 'ঠিক তাই। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল, আলোর পথ ধরে এগোতে হবে। আমি এখন সবদিকেই আলো দেখছি। তবে একদিকে কম আলো, আরেক দিকে বেশি আলো। তোমাদের কী মনে হয়? আমাদের কোনদিকে যাওয়া উচিত?' 'যেদিকে আলো বেশি চলো সেদিকেই যাই।' কে যেন একজন পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই সহমত হয়ে বলল- 'চলো, যেদিকে বেশি আলো সেদিকে চলো।' এরপর সবাই গুটি গুটি পায়ে যেদিকে বেশি আলো, সেদিকে চলতে শুরু করল। কিন্তু হায় ওই দিকে আসলে সাগর ছিল না। সেদিক থেকে আসছিল শহরের উজ্জ্বল আলো। সাগর পাড়ের আলোকিত রাতের শহর। কচ্ছপগুলো মৃতু্যর দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে এভাবেই কচ্ছপ শিশুগুলো ভুল করছে। আর শহরে প্রবেশ করে অকালেই মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রম্নতই পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে এই কচ্ছপ প্রজাতি। এদিকে কচ্ছপ শিশুদের দলটি কিছু পথ এগিয়ে গেল। হঠাৎ কাঁকড়া দলের আক্রমণের শিকার হলো তারা। কাঁকড়াদের হাত থেকে বাঁচতে পারল কিছু কচ্ছপ শিশু। তবে বেশির ভাগ কচ্ছপ মারা পড়ল। বেঁচে থাকা শিশুগুলো খুব দ্রম্নত ছুটে চলল। এরপরে তারা গিয়ে উপস্থিত হলো একটি বড় রাস্তায়। রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে অনেক গাড়ি। কচ্ছপ শিশুগুলো গাড়ির আলো, হর্নের শব্দে খুব বিপদে পড়ল। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা গেল আরও কয়েকটা কচ্ছপ। দলনেতা কচ্ছপটি রাস্তা পার হয়ে বেঁচে থাকা সবাইকে একসঙ্গে হতে বলল। এবার সে গুনে দেখল, তারা মাত্র ছয়জন বেঁচে আছে। দলনেতা বলল, 'শোনো আমরা ভুল পথে এসেছি। কিন্তু আমাদের ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ফিরতে গেলেও আমরা মারা পড়ব। মানুষের শহরে চলে এসেছি আমরা। আমাদের অভিভাবকরা এ বিষয়ে সচেতন করেছিল। কিন্তু আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং বিপদে পড়েছি। এখানেও নিশ্চয় জলাশয় আছে। আমরা যে যেদিকে পারি ছুটে যাব। পানি খুঁজে বের করতে পারলে, আমরা বেঁচে যাব। আমরা বাঁচতে চাই। তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। আর হয়তো আমাদের একে অন্যের সঙ্গে দেখা হবে না। অথচ সাগরে গেলে আমরা সবাই একসঙ্গেই বড় হতাম। আমাদের বাবা-মাকে খুঁজে পেতাম। আমাদের জীবনটা সুন্দর হতো। যাই হোক বিদায় বন্ধুরা।' এই বলে কচ্ছপ শিশুগুলো একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিল। তারা জানেনা সামনে আর কী কী বিপদ অপেক্ষা করছে। কিংবা হয়তো তারা সব বিপদ পার করেছে। তারা ছুটে চলল সামনের দিকে। একেক জন একেক দিকে। অজানা অচেনা পথ। তবু বাঁচার জন্য এ ছুটে চলা। এভাবে যেতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে মারা গেল একটি কচ্ছপ। একটি কচ্ছপ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেল। একটি কচ্ছপ ড্রেনের ভিতরে পড়ে গেল। ময়লা, বদ্ধ ড্রেনের পানিতে সে দম নিতে পারল না। মারা গেল কচ্ছপটি। একটি কচ্ছপ একটি দূষিত পানির ডোবা খুঁজে পেল। সে ভাবল, পানি পেয়েছি। আমি বেঁচে গেলাম। ডোবাটির ভিতরে ছিল অনেক আবর্জনা। সেখানে সাঁতার কাটতে গিয়ে পস্নাস্টিকের একটা প্যাকেটে আটকা পড়ল কচ্ছপটি। আর সেখানেই বদ্ধভাবে সে মারা গেল। একটি কচ্ছপ মোটর গাড়ির চাকার তলায় পড়ে মারা গেল। এখনো বেঁচে আছে দলনেতা কচ্ছপটি। অনেকখানি পথ সে পার হলো হেঁটে হেঁটে। ভাগ্যজোরে সে বেঁচে গেছে অনেক রকম বিপদ থেকে। দলনেতা কচ্ছপটি হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু থামল সে। ঘাসের মধ্যে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য, সে কিছুক্ষণ বসে থাকল। সে আসলে রুবিদের বাগানে পৌঁছে গেছে। রুবির বয়স বারো বছর। সে মায়ের সঙ্গে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিল। রাতের খাবার খেয়ে প্রতিদিন তারা এভাবে হাঁটাহাঁটি করে। হঠাৎ রুবির মনে হলো, ঘাসের মধ্যে কি যেন একটা নড়ছে। আরও কাছে গিয়ে রুবি দেখতে পেল কচ্ছপটিকে। সে চিৎকার করে মাকে কাছে ডাকল। রুবি কচ্ছপটি ধরতে সাহস পেল না। তার মা কচ্ছপটি হাতে তুলে নিল। দেখল তখনও কচ্ছপটি বেঁচে আছে। তিনি রুবিকে বললেন- 'বেঁচে আছে কচ্ছপটি। জলদি একটা মগে পানি নিয়ে আস।' রুবি এক দৌড়ে বাথরুমে গেল। সেখান থেকে বড় মগে করে পানি আনলো। রুবির মা কচ্ছপটি মগের পানিতে ছেড়ে দিলেন। আহত কচ্ছপটি যেন প্রাণ ফিরে পেল। আর একটু দেরি হলেই, সেও হয়তো মারা যেত। তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। কচ্ছপটি মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে রুবির মা একটা কাচের জার আনলেন। সেই জারে পানি দিয়ে কচ্ছপটিকে রাখা হলো। এভাবে কচ্ছপটি কতদিন বাঁচবে সে জানে না। তবু সে স্বস্তি পেল। কিন্তু তার মনে ভাবনা কাজ করছিল। সে তার সঙ্গীদের কথা ভুলে যায়নি। তাদের নিয়ে কচ্ছপটি চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার আরও মনে হলো, আগামী রাতে আবার যে কচ্ছপগুলো জন্ম নেবে তাদেরও কী একই অবস্থা হবে? কিন্তু কচ্ছপটির তো কিছুই করার নেই। সে কীভাবে রক্ষা করবে আগামী কচ্ছপ শিশুগুলোকে? একমাত্র মানুষ পারে তাদের রক্ষা করতে। কিন্তু মানুষ কবে এ বিষয়ে সচেতন হবে, তা জানা নেই ওই কচ্ছপ শিশুটির।