ভিনদেশি গল্প

শামুক ও গোলাপ

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মূল গল্প: হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন অনুবাদ : মামুন- সিরাজী
সে এক বিশাল আর সুন্দর বাগান। কতশত ফুল সেখানে তার গোনাগুনতি নেই যেন। কোথাও ফুটেছে দলে দলে রজনীগন্ধা, কোথাও বা চন্দ্রমলিস্নকার ঝোপ, কোথাও আবার হাসনাহেনার একটা ঝাড়। আরও যে কত ফুল সে বাগানে ফোটে তার কোনো লেখাজোখা নেই। বাগানের এত সুন্দর সুন্দর বাহারি ফুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই গোলাপগাছটিকে, যাতে ফোটে লাল টুকটুকে সব গোলাপ। সারা বছর এমন সুন্দর গোলাপ ফোটে এতে যে- যে দ্যাখে সেই-ই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আর এই গোলাপগাছটির ঠিক নিচেই একটা গর্তে থাকে মস্ত একটা শামুক। শুকনো তার মোটা খোল- সে খোলের ভেতর রয়েছে তার থলথলে শরীর। একদিন ভোরবেলা হাই তুলতে তুলতে শামুক তার খোলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সুড়সুড় করে। গোলাপ গাছকে ডেকে বলল- কী হে ভায়া, করছ কী? কাজ-কর্ম কিছু নেই বলে কেবল তাড়াহুড়ো করে ফুলই ফুটিয়ে যাচ্ছো? ভালো কাজ করতে চাও তো- আমার মতো আস্তে আস্তে কাজ করতে শেখো! আমি পৃথিবীতে যত বড় কাজ করে যাব, তেমন কাজ কী তুমি কখনো করতে পারবে? গোলাপগাছ মাথা নুয়ে সম্মান জানালো শামুককে। গোলাপ বলল- সে তো বটেই, আপনি কত বয়োজ্যেষ্ঠ, কত জানেন! আপনার কাছ থেকেই তো আমরা এমন কাজই আশা করি। তা কবে সেই বড় কাজটি করবেন? কবে, কখন হবে, তা অত ভাবার দরকার কী? তোমার যত তাড়াহুড়ো, সেই জন্যই তুমি কোনো বড় কাজ করতে পারো নাহ! বলতে বলতে শামুক তার কালো রঙের শক্ত খোলের ভেতর ঢুকে পড়ল। সারা বছর সে কোনো কাজই করল না, কেবল গোলাপগাছের নিচে এক জায়গায় শুয়ে ঘুমিয়ে কাটালো। নতুন বছর এলো। নতুন বছরের ভোরে শামুক আবার বেরুলো তার সেই শক্ত কালো খোলের ভেতর থেকে হাই তুলতে তুলতে- গোলাপগাছকে ডেকে জানতে চাইল- কী হে গোলাপ? বলি বুড়ো হতে চললে যে! সারা বছরজুড়ে ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে নিজের যেটুকু ক্ষমতা ছিল তা তো শেষ করে দিলে, কিন্তু লাভ কী হলো তাতে? আমার দিকে তাকিয়ে দেখো দেখি- এই এক বছর ধরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিজের কত উন্নতি করলাম? তোমার মতো তো আমি শক্তির অপচয় করে নিজের যোগ্যতা শেষ করছি না। দেখো আমাকে আমি নিজের ভেতর শক্তি জমিয়ে রাখছি, শামুক একটু দম নিয়ে আবার বলে- আচ্ছা এতকাল তো ফুল ফুটিয়ে চলেছো, কিন্তু কখনো ভেবেছো কী কেন ফুল ফোটাচ্ছো, বা ফুল ফোটানোর মানেটাই বা কী? আর ফুল ফুটলেই বা কি-না ফুটলেই বা কি? শামুকের এত প্রশ্নের মুখে গোলাপগাছ রীতিমতো থতমত খেয়ে গেল! গোলাপ গাছ বলল- না তো, কখনো তো একথা আমি ভেবে দেখিনি? ফুল ফোটাতে ভালো লেগেছে। না ফুল ফুটিয়ে থাকতে পারিনি- তাই ফুটিয়েছি। সূর্য তার আলো ছড়িয়ে দিয়ে আমার শিরায় শিরায় জ্বালিয়ে দেয়। দখিনা বাতাস আমার পাতায় পাতায় ঠান্ডা হাত বুলিয়ে যায়, ভোরবেলার শিশির দেয় আমার মুখ ধুইয়ে আর বর্ষার স্নিগ্ধ জল আমায় গা ধুইয়ে দেয়! আনন্দে আমার পাপড়িগুলো কাঁপতে থাকে, আমি কিছুতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না- নীল আকাশের নিচে আমি সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে ফুটে উঠি। জীবনটা তোমার খুব মজার দেখছি- শামুক ফোড়ন কেটে বলে! তা অবশ্য মিথ্যে নয়- তবে আপনার জীবনও তো কম সুন্দর নয়! আপনি পৃথিবীর যত উপকার করবেন, তা কী আর আমি কখনো করতে পারব- গোলাপগাছ সবিনয়ে বলে। শামুক নাক সিঁটকালো! কী সব বলো, আমি পৃথিবীর উপকার করব? বোকার মতো কথা বলো- শুনলে হাসি পায়! নিজের উপকার করাই হলো সবচেয়ে বড় কাজ- এই কথাটিই সর্বদা মনে রেখো। তোমার মতো ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে শুকনো কাঠি হয়ে মরার কি কোনো দাম আছে? গোলাপগাছের দিকে কটমট করে তাকাতে তাকাতে শামুক রাগে গটগট করে খোলের ভেতর ঢুকে ঘুমুতে লাগলো সামনের দরজা এঁটে। গোলাপগাছ নিঃশ্বাস ফেলে বলল- আমি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারি না। বাব্বাহ, কিরকম গুটিসুটি মেরে ঢুকে গেল খোলের ভেতর, বাইরেও ওর কোনো নাম নিশানাও রইল না। আমি তবে ওরকম করে কিছুতেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে পারব না! ফুল ফুটিয়ে গন্ধ বিলিয়ে আমি রোগা হয়ে যাই দিন দিন তা সত্যি; কিন্তু ছোটরা যখন খেলতে এসে আনন্দে আমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়, পথিকেরা পথ চলতে চলতে থেমে যায়- অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তখন আমার কী যে ভালো লাগে! এই ভালো লাগার মানে কি আর শামুক বুঝবে? শামুক কিন্তু গোলাপগাছের এসব কথা শুনতেই পারল না, কেননা- সে তো নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। এমনি করেই কেটে গেল অনেক বছর। গোলাপগাছ কত ফুল ফোটালো, ছড়ালো মাতাল করা সুগন্ধ, আনন্দ জাগালো সবার মনে। তারপর একদিন মারা গেল। যতদিন তারা বেঁচেছিল- যখনই দেখা তার হতো শামুকের সঙ্গে, তখনই শামুক- কর্মপদ্ধতি, মহতী কাজ এবং মহত্ত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দিত শেষে ক্লান্ত হয়ে আবার নিজের খোলের ভেতর ঢুকে যেত। গোলাপগাছ কখনো বুঝতে পারেনি, কার জীবন সুন্দর- তার না শামুকের? তুমি বলতে পারো- কার?