তোমাদের গল্প

ছোটদের কবি ছোটদের রবি

প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

আবু আফজাল সালেহ
'মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা,/মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা।/মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো/চারিদিকের দেয়ালজুড়ে ছায়া কালো কালো।/বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু-প ঝু-প ঝুপ-/দস্যি ছেলে গল্প শোনে, একেবারে চুপ।/তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান-/বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, নদে এলো বান।' বহুল প্রচারিত ও মুখেমুখে প্রচলিত এ ছড়াটি কার লেখা আর বলা লাগে না। ঠিকই ধরেছ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর' শিশুতোষ এ ছড়াটি আজ ব্যাপক জনপ্রিয়। বৃষ্টি কবি মনকে খুবই দোলা দিত। আষাঢ় আর শ্রাবণ নিয়েই কবি শতাধিক গান রচনা করেছেন। রবিঠাকুর নামেই পরিচিত তিনি। তিনি ১৮৬১ সালের ৭ মে বাংলা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটদের জন্যও তিনি ছড়া-কবিতা-নাটক লিখেছেন। সংখ্যায় কম হলেও তা ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জন্য প্রবাদপুরুষ। তিনি ছোটদের জন্য অনেক মিষ্টি মিষ্টি ছড়া, কিশোর কবিতা ও গল্প লিখেছেন। ভ্রমণকাহিনী বা জীবনীও লিখেছেন। লিখেছেন শৈশবকালের আত্মজীবনী। অতি সহজ-সরল ভঙ্গিতে। যা শিশুমনে সহজেই গ্রহণ করতে পারে এবং কিছ ুকিছু কবিতা-ছড়া বা বিষয় আজীবন মনে থাকবে। তেমনি চমৎকার একটি ছড়া। মনের অজান্তেই কোনোরকম গলার কষ্ট ছাড়াই বলা যায় আবার গান হিসেবেও গাওয়া যায়! 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি,/আজ আমাদের ছুটি ও ভাই/আজ আমাদের ছুটি।' আগেই বলেছি তিনি কিন্তু তোমাদের জন্য অনেক কিছুই লিখেছেন। যেমন ধরো- 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার/হাঁটু জল থাকে...।' 'কিচিমিচি করে সেথা/শালিকের ঝাঁক/রাতে উঠে থেকে থেকে/শেয়ালের হাঁক...।' অথবা- 'এক যে ছিল চাঁদের কোণায়/চরকা কাটা বুড়ি,/পুরাণে তার বয়স লেখে/সাতশ হাজার কুড়ি...।' কি মিষ্টি ছড়া! তাই না! এমন কোনো বাঙালি নেই এগুলো শোনেনি! শিশুদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। 'বীর পুরুষ' কবিতাটি অনেকেই পড়েছ। তিনি লিখেছেন- 'মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/ দরজা দুটো একটু ফাঁক করে।...' -অসম্ভব ছন্দমিল, শিল্পের নান্দনিকতা রয়েছে। কবিরা বৃষ্টি ভালোবাসেন। কবিগুরুও বৃষ্টিকে ভালোবেসে অনেক ছড়া, কবিতা গান লিখেছেন। কবি প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। পাখির কিচিরমিচির গান গাওয়া, নদীর কলকল ছলছল ছুটে চলার ধ্বনি কবির মনকে দোলা দিয়েছে। এসব কথা তার বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। এবং কত সুন্দরভাবেই আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে কবি বলেছেন- 'নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ও গো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে...' কবি চাঁদকে নিয়ে লিখতেও ভুলে যাননি। চাঁদকে নিয়ে লিখেছেন একটি চমৎকার ছড়া-কবিতা-'দিনের আলো নিভে এল/সূর্যি ডোবে ডোবে/আকাশ ঘিরে মেঘ ছুটেছে/চাঁদের লোভে লোভে...।' 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে'- (তালগাছ) তখন মনে হয়, কোনো চিরপরিচিত গ্রামের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তালগাছটা একটা মানুষ হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো আবার তিনি হয়ে গেছেন মাঝি। বলেছেন- 'আমার যেতে ইচ্ছে করে/নদীটির ওই পাড়ে,/ যেথায় ধারে ধারে/বাঁশের খুঁটায় ডিঙি নৌকা/বাঁধা সারে সারে।...' (মাঝি) তিনি ছোটদের জন্য অনেক গল্পও লিখেছেন। 'ছুটি' রবীন্দ্রনাথের একটি শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ফটিক চক্রবর্তী। এখানে লেখক খুব সুন্দরভাবে দুষ্টুমি ও করুণ কাহিনী তুলে আবার আমরা কাবুলিওয়ালা নাটকে মিনিকে দেখি ভিনদেশী এক লোককে আপন করে নিতে। এখানে মিনির শিশু চরিত্রকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নাটকও রচনা করেছেন ছোটদের জন্য। তার 'ডাকঘর' নাটকটি সবার কাছেই অনেক প্রিয়। দই ! দই ! দই নেবে দই... অমল নামের ছোট্ট ছেলেটির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে মন চায় সবার। তখন মনে হয়, আমাদের ঠিক পাশ দিয়ে যেন দইয়ের ডুগি নিয়ে ছুটে চলেছে কোনো লাল মাটির দেশের দইওয়ালা। আমাদের জাতীয় সংগীত রবিঠাকুরের লেখা। কি সুন্দর বাণী! 'আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি...' তোমরা জেনে খুশি হবে এই ভেবে যে তিনি কিন্তু ভারতের জাতীয় সংগীতও রচনা করেন। কত বড় কবি ভেবেছো! বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান। ১৯১৩ সালে 'গীতাঞ্জলি' রচনা ও তার ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য! হঁ্যা বলে রাখি এ কাব্যের অনুবাদের কাজ কিন্তু তিনি বাংলাদেশের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতেই শুরু করেছিলেন। অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার অনেক অনেক গ্রন্থের মধ্যে এখানে কয়েকটির নাম তুলে ধরা হলো। গীতাঞ্জলি, বলাকা, চিত্রা, মানসী, সোনার তরী, গোড়া, শেষের কবিতা, রক্ত করবী অন্যতম। আগেই বলেছি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পদক পান। যা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এই মহান কবি ও সব্যসাচী লেখক, বিশ্বকবি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট মারা যান। তার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা। বাইশে শ্রাবণ সামনে নিয়ে কবিগুরুর ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে করে- 'এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়/এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরোঝরে/তপনহীন ঘন তমসায়।'