শিশুতোষ গল্প

নীতুর নৌকা ভ্রমণ

প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
নীল পরীর সঙ্গে নীতুর বন্ধুত্ব বেশ ভালোই জমে উঠেছে। এখন আর সে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে না। নীল পরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে নীতুর মনের সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। এখন তার আব্বু-আম্মুর প্রতিও তেমন কোনো অভিযোগ ও অভিমান নেই। আগের মতোই প্রতিদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে হোম ওয়ার্ক করে নেয়। তারপর যখন বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিতে যায়, তখনই আসে তার খেলার সাথী নীল পরী। কেউ বিশ্বাস করবে না ভেবে নীল পরীর কথা এখন পর্যন্ত নীতু কাউকে বলেনি। নীতু অনেকবার চেয়েছিল তার আব্বু-আম্মুকে নীল পরীর কথা বলবে। কিন্তু নীতুর মনে একটা ভয় ছিল, যদি তার আব্বু-আম্মু নীল পরীকে আর আসতে না দেয়। তাছাড়া বর্তমানে এই নীল পরী হচ্ছে নীতুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তার নিঃসঙ্গ সময়ের একমাত্র সঙ্গী। তাই সে কোনোভাবেই নীল পরীকে হারাতে চায় না। এসব কারণে নীল পরীর রহস্য শুধু নীতুর কাছেই সীমাবদ্ধ থাকল। নীতুর আব্বু-আম্মু অফিসের কাজে ঘরের বাইরে ব্যস্ত থাকার কারণে নীতুকে সময় দিতে না পারলেও ছুটির দিনে সবাই মিলে ঘুরতে বের হয়। ওর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে বাইরে ঘুরতে নীতুর ভীষণ ভালো লাগে। নীতুর আব্বু-আম্মু নীতুকে নিয়ে সাধারণত শহরের ভেতরেই ঘুরতে বের হন। তবে নীতুর পছন্দ হচ্ছে গ্রাম ও প্রকৃতি। সে গ্রামে যেতে চায়, প্রকৃতির মাঝে ঘুরতে চায়। কিন্তু নীতুর আব্বু-আম্মুর সেই সময় ও সুযোগ নেই। এদিকে বর্ষাকাল চলছে, প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। নীতু টিভিতে দেখেছে গ্রামের চারপাশে এখন থৈ থৈ পানি। নদী ফিরে পেয়েছে তার যৌবন। তখন থেকেই নীতুর খুব ইচ্ছে হচ্ছে গ্রামের প্রকৃতি দেখার। সে নৌকা ভ্রমণ করে গ্রামে যেতে চায় এবং নদীর তীরঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কাশবনে দূরন্ত বালিকার মতো ছোটাছুটি করতে চায়। বারবার তার আব্বু-আম্মুর কাছে বায়না করেও কোনো লাভ হলো না। তাই নীতুর ভীষণ মন খারাপ কিন্তু করার কিছুই নেই। এক দুপুরে বিছানায় শুয়ে নীতু চিন্তা-ভাবনা করছে, কীভাবে তার আব্বু-আম্মুকে ম্যানেজ করে গ্রামে গিয়ে নৌকা ভ্রমণ করা যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে নীতুকে চমকে দিয়ে নীল পরী হাজির। নীতুকে আরও বেশি চমকে দিয়ে নীল পরী বলে উঠল, 'চলো, আমরা দুজন মিলে নৌকা ভ্রমণে বের হই।' নীল পরীর কথা শুনে মনের অজান্তেই নীতুর চোখের কোণে পানি জমে যায়। নীতুর চোখের পানি মুছে দিয়ে নীল পরী নীতুকে বলল, 'আর কখনো কাঁদবে না, নয়তো আমি আর আসব না।' তখন নীতু বলল, 'জানি না কীভাবে যেন তুমি আমার মনের কথাগুলো জেনে যাও। তোমার মতো বন্ধুর তুলনা হয় না। তুমি থাকতে কান্নার প্রশ্নই ওঠে না।' নীল পরী তখন বলল, 'এখন কি কথা বলেই সময় কাটাবে, নাকি নৌকা ভ্রমণের জন্য বের হবে?' নীতু তখন নীল পরীকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু দিয়ে বলল, 'চলো.. চলো.. চলো যাই নৌকা ভ্রমণে।' সঙ্গে সঙ্গে নীল পরীও বলে উঠল, 'হিপহিপ হুররে...।' তারপর নীল পরী নীতুকে নিয়ে উড়তে উড়তে চলে গেল একটা নদীর তীরে কিন্তু সেখানে কোনো নৌকা ছিল না। নীতু জিজ্ঞেস করল, 'এখন নৌকা পাবে কোথায়?' তখন নীল পরী তার জাদুর ছড়ি ঘুরাতেই নদীর তীরঘেঁষে খুব সুন্দর একটা নৌকা চলে এলো। তারা দুজনেই নৌকাতে গিয়ে বসল। তখন নীতুর আবার জিজ্ঞাসা, 'তুমি কি নৌকা চালাতে পারো? আমি কিন্তু নৌকা চালাতে পারি না।' নীল পরী হাসতে হাসতে জানালো, 'এই নৌকা তোমার ইচ্ছে মতো চলবে, তুমি যেদিকে যেতে চাইবে।' এই কথা শুনে নীতু অবাক বিস্ময়ে নীল পরীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর পরীক্ষা করে দেখার জন্য নীতু নৌকাটাকে বলল, আমাদের সুন্দর একটা গ্রামের দিকে নিয়ে যাও। নীতুর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই নৌকা নিজে নিজেই নদীর তীরঘেঁষে চলতে শুরু করল। তখন শীতল বাতাসে নীতুর শরীর ও মন জুড়িয়ে গেল। ওর মনে আজ সীমাহীন আনন্দ। যেন এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। নৌকা যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, নীতু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। নদীতে এক এক করে বিভিন্ন ধপ্রণর নৌকা যাচ্ছে। কোথাও হাঁসের পাল দল বেঁধে ভাসছে, পানকৌড়ি ও মাছরাঙা নদীর বুকজুড়ে উড়ছে। জেলেরা নদীর জলে জাল ফেলে মাছ ধরছে। নদীর দুই পাড়ে সারি সারি সবুজ গাছের সমাহার। সেখানে নানা জাতের পাখির মিছিল। এসব দেখতে দেখতে এক সময় একটি গ্রামের কাছে গিয়ে নৌকা থামল। নীতু ও নীল পরী গ্রামের ভেতরে ঘুরতে গেল। গ্রামটি ছিল ছবির মতো সুন্দর। গ্রামের ঘর-বাড়ি, মেঠো পথ-ঘাট, গাছপালা, পশু-পাখি দেখে নীতুর ভীষণ ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগছে গ্রামের মানুষের ব্যবহার। শহর থেকে আসা ছোট্ট নীতুকে সবাই ভালোবেসে আদর করছে। নীতু ও নীল পরী গ্রামের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কুতকুত, বউছি ও গোলস্নাছুট খেলেছে। নীতুর সে কি আনন্দ কিন্তু এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। তখন নীতুর বাসায় ফেরার কথা মনে পড়ে গেল। ওরা গ্রামের সবার থেকে বিদায় নিয়ে একটু আড়ালে যেতেই নীল পরী নীতুকে নিয়ে উড়তে উড়তে আবার ওর বাসায় পৌঁছে দিল। এবার নীল পরী বিদায় নিতে চাইলে নীতু তার বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তখন নীতুর কপালে চুমু কেটে আদর করে নীল পরী আবার দেখা হবে বলেই উড়তে উড়তে চলে যায়।