শিশুতোষ গল্প

মিশু আর চন্দনের গল্প

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অরণ্য প্রভা
গত বছর মিশুর বাবাকে যখন হাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন চন্দনকে বুকে টেনে নিয়ে অনেক সময়ে ধরে বিশুর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়েছিলেন চন্দনের মা। এই এক বছরে চন্দন অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। মায়ের সঙ্গে এখন দইয়ের সরা বানানোর কাজে দিব্যি চাক ঘুরাতে পারে। হয়তো সে কারণেই মায়ের কাছে চন্দনের কদর আর আদর দুটোই বেড়েছে। শুধু যে চন্দনের প্রতি আদর-যত্ন তা কিন্তু নয়- মিশুর প্রতিও। মিশুও ভেবে পায় না তার প্রতি ইদানীং এত আদর-যত্ন কেন। এই কিছুদিন আগেও গাংনাই নদীর পাশে ভিটার ঘাস ছাড়া কিছুই জুটত না মিশুর কপালে। এখন সেই মিশুর নিয়মিত খাবার লেটুস পাতা, কাঁঠালপাতা, ভুসি আরও কত কী? মিশুর প্রতি মায়ের এত মায়া দেখে চন্দন মাকে প্রশ্ন করে- মা, বাবা কি সত্যিই মিশুরে বিক্রি করে দেবে? স্কুলের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, বই নিয়ে চন্দন ভোঁ-দৌড় দিয়ে ডালিমগাছের নিচে দাঁড়ায়। মিশুর মাথায় হাত বোলায়, মিশুর চোখ বেয়ে নেমে গেছে অশ্রম্নরেখা। মিশুও চন্দনের পিছু পিছু ছোটে। চন্দনের পিছু ছুটতে ছুটতে গাংনাই নদীর পুল পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসে। মিশু এই পালপাড়ার সব ভিটে তন্ন তন্ন করে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ঘাস খায়। কখনো ক্ষেতের ফসলে মুখ দেয় না। মিশুর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাড়ার সবাই চেনে। মোড়ের মুদিদোকানের খরিদ্দাররা কেউ কেউ আবার চা-বিস্কুটও খাওয়ায় মিশুকে। ছুটি শেষে বাড়ি ফিরে চন্দন মায়ের মুখে শোনে মিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ মিশু বেরিয়ে পড়ে। পালপাড়া ঘুরে ঘুরে খুঁজতে খুঁজতে পলাশপুরের একেবারে উত্তরপাড়ায় এসে পড়ে চন্দন- যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। চন্দনের ধারণা এখানেও ওর মিশুকে পাওয়া যেতে পারে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেঁধে রেখেছে জরি দিয়ে সাজানোর নাদুসনুদুস চেহারার নানান রঙের গরু-ছাগল। যেগুলোকে কোরবানি করা হবে। অদূরেই কয়েকটা ছাগল বাঁধা। চন্দন দৌড়ে যায় সেদিকে। দু'একটা মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে। আজানের সেই সুরকে উপেক্ষা করে একটা ছাগলের ভ্যা... ভ্যা... ভ্যা... আওয়াজ কানে আসে। ছাগলটার কাছে যাওয়ামাত্র আরও জোরে ভ্যা... ভ্যা... ভ্যা... করতে থাকে। চন্দনের চোখে তখন আনন্দের অশ্রম্ন। চন্দন তার মিশুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। আর তখুনি ক্রেতা ছাগলটার মালিক এসে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে-চোর... চোর... ছাগল চোর। ছাগল চোর ভেবে চন্দনকে আচ্ছামতো পেটানো হয়। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর শেষে ছেড়ে দেয়া হয় চন্দনকে। চন্দনের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। চন্দন ঘুমঘোরে বলে যাচ্ছে- আমি চোর না, সত্যি করে বলছি আমি চোর না, আমি আপনাদের ছাগল চুরি করতে আসিনি। আমি পালপাড়ার সুশীল পালের ছেলে চন্দন। বিশ্বাস না হয় আমারে পালপাড়ায় তার বাড়িতে নিয়ে চলেন। এই ছাগলডা আমার খুব আদরের ছিল। আমি আমার মিশুরে ছাড়া থাকতে পারি না...। জ্বরের ঘোরে ছেলের কথা শুনে বাবা-মা আপনা-আপনিই কষ্ট পেতে থাকেন। সকাল হলে চন্দনকে কী উত্তর দেবে তারই একটা যৌক্তিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। ছাগলটার ভ্যা... ভ্যা... শুনে চন্দন ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠে। ঠিক ঠিক ডালিমগাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে মিশু। চন্দন তখন চিৎকার মেশানো আনন্দে মাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় ট্রাঙ্কটা খোলা। বাবা ঘরে নেই। মা উঠান ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। ছোটবেলায় এই ট্রাঙ্ক খুলে দেখার অনেক সাধ জাগলেও সবসময় তালা ঝোলানো থাকায় সেই ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়নি চন্দনের। আজ ট্রাঙ্কটা খোলা দেখে পুরনো ইচ্ছেটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ট্রাঙ্কের মধ্যে দেখতে পায় টাকার বান্ডিল। বিস্ময় এসে ভর করে তখন চন্দনের মনে। সন্দেহ মনের অলিন্দে এসে যে প্রশ্ন তৈরি করে চন্দনের, সেটা হলো-এত টাকা বাবা কোথায় পাবেন? নাকি সত্যি সত্যিই আমার মিশুরে বিক্রি করে দিয়েছেন? হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পড়িমরি করে ছাগলকে অনুসরণ করে আসতে একটু দেরিই হয়ে যায় লোকগুলোর। ছাগলের দৌড়ের সঙ্গে কি আর মানুষ পেরে ওঠে। ওদের মধ্য থেকে তৌফিক নামের একজন বলে ওঠে- এই যে এই ছাগলটাই তো আমার। এবার তার মনে পড়ে গতরাতে ছেলেটাকে পিটানোর সময় অনুনয়-বিনয় করে বলা চন্দনের বাবার কথা। তাই লোকটি জিজ্ঞেস করে চন্দনের মাকে- এটা কি সুশীল পালের বাড়ি? প্রশ্নের মধ্যেই এসে হাজির হন সুশীল পাল। চন্দন ঘর থেকে বেরিয়ে দ্যাখে-ওই ডালিমগাছটার নিচে বাবার সঙ্গে কী যেন বলাবলি করছে লোকগুলো। চন্দন এগিয়ে যায় মিশুর কাছে। লোকটা সুশীল পালকে অনুরোধের সুরে বলছেন- কোনোকিছুর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অনেক করে ভাবতে হয়, সেই ভাবনার ধৈর্যটাই আমরা হারিয়ে ফেলি, যে কারণেই এমনটি ঘটেছে। আমি ছাগলটা ফিরিয়ে নিতে আসিনি, আমায় ক্ষমা করবেন- পিস্নজ! চন্দন লোকটাকে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়, আর মনে মনে আক্ষেপ নিয়ে বলতে থাকে- আরে এটা তো সেই লোক! যে গতকাল আমাকে চোর চোর বলে আচ্ছা করে পিটিয়েছেন। ডালিমগাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধানো মিশুও তখন ভ্যা... ভ্যা... বলে হয়তো-বা পিটুনির ঘটনারই প্রতিবাদ জানায়।