শিশুতোষ গল্প

শরতের রাতে বাদুড় ভূত

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আশরাফ আলী চারু
শরৎকাল, ঘন নীল আকাশ। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। দেখে মনে হয় পেঁজা তুলোরা ভেসে যাচ্ছে দূর অজানার পথে। পথে-ঘাটে-মাঠে শিউলি ফুল ফুটে আছে। বিলপাড়, নদীপাড়ে শুভ্র কাশফুল ছেয়ে আছে। নদীতে বয়ে যাচ্ছে পাল তোলা নাও। এরকম দৃশ্যে অংকিত একটি ছবি দেখার পর মাহিনকে তার গাঁ হাতছানি দিয়ে ডাকে। আর তাই শহরের ব্যস্ততম জীবন থেকে একটু অবসর নিতে কিংবা শরতের খোলা আকাশ দেখতে সে মনে মনে গাঁয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। মাহিনের বয়স পনেরো বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। মা আর দুই বোনের খাওয়া-পরার সব জোগান দিতে হচ্ছে তাকেই। তাই সে নিজের লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিশুশ্রমের ভিত্তিতে একটি ম্যাচ কারখানায় কাজ করে। চার মাস হলো গ্রাম থেকে এসেছে। প্রতি মাসের বেতনের টাকা বিকাশ করে বাড়িতে পাঠিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করে সে। বাড়ি যাওয়ার ভাড়ার টাকা থাকে না বলে সে বাড়িতে যাচ্ছি যাচ্ছি করে চার মাস পার করে দিল। অথচ তার বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু আজ পত্রিকার পাতায় শরতের ছবিটি দেখে গাঁয়ের টানে মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। কারখানার মালিককে ভয়ে ভয়ে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানালো। মালিক মাহিনের মুখের দিকে চেয়ে না করতে পারল না। ছেলেটি চার মাস ধরে এসে একবারও বাড়ি যাওয়ার কথা বলেনি। কাজে-কামে ছেলেটি খুব মনোযোগী। এতদিন পর বাড়িতে যেতে চাইছে- যাক। এই ভেবে সাপ্তাহিক খোরাকি হাতে ধরিয়ে দিয়ে মালিক দুদিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন। বলে দিলেন দুদিনের বেশি থাকা হলে চাকরিটা হারাতে হবে তাকে। একথাটা মালিক কেন বললেন সেটা বোঝার মতো বয়স এখনো মাহিনের হয়নি। মাহিন মালিকের শর্ত মেনে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে পথ ধরল। ভাগ্য ভালো বলে কমলাপুর এসে ট্রেনও পেয়ে গেল। গাড়িতে বসে বারবার পত্রিকার সেই দৃশ্য সে দেখতে লাগল। সারা পথেই এই দৃশ্যের মহামায়ায় এমন মগ্ন থাকল, কখন সে তার বাড়ির কাছের স্টেশনে এসে পৌঁছল বুঝেই উঠতে পারল না। স্টেশন থেকে চন্দ্রিমা মাখা রাতে হেঁটে হেঁটে সে বাড়িতে পৌঁছল। খুব ভালো লাগল তার। কিন্তু বাড়ির খুলির মুখে এসে উঠানে লোকজনের গলা শুনে সে বিস্মিত হয়ে গেল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, এত রাতে বাড়িতে এত লোকজন কেন? সে ভয়ে ভয়ে বাড়ির উঠানে এসে দেখল- তার ছোটবোন টুনি চেঁচিয়ে বলছে- আমাকে ছেড়ে দাও আমি আর জীবনেও এরকম করব না। আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে ছেড়ে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ওপাড়ার এক ওঝা একটি সাপ টুনির চোখের কাছে ধরে ছোবল দেয়ানোর চেষ্টা করছে। আর টুনি ভয় পেয়ে আবোল-তাবোল কি সব বকে যাচ্ছে। এসব কান্ড দেখে মাহিন প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। আরেকদিন বাড়ি ফেরার সময় যে মা পথে দাঁড়িয়ে থাকে সে মা আজ টুনির এমন দুঃসময়ে ব্যস্ত। মা এবং টুনির করুণ পরিণতি দেখে সে ভিড় ঠেলে লোকজন সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল- টুনির কি হয়েছে? দু-একজন বলে উঠল মাহিন এলি, যাক ভালোই হয়েছে। কেউ বলে উঠল টুনির এই দুঃসময়ে এসে ভালোই করেছিস। গতরাতে টুনিকে ভূতে ধরেছে। ওঝা বেটা বলে উঠল একি যেমন-তেমন ভূত নাকি? জাত বাদুড় ভূত। দেখো না ছাড়তে চাইছে না। রাখেন আপনার বাদুড় ভূত! সাপ সরান। ছোট একটা মানুষকে সাপের ভয় দেখাচ্ছেন? এসব ভন্ডামি বাদ দিয়ে এখনো ভালো হন না কেন? কবরে এক পা গেছে। আর কত ঠকাবেন গাঁয়ের সাধারণ মানুষকে। এই বলে ওঝাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে টুনিকে বুকে নিয়ে বলতে লাগল- টুনি বোন আমার তোর কিছুই হয়নি। দেখ আমি চলে এসেছি তোর কোনো ভয় নেই। এবার গলাটা আরও একটু চড়িয়ে মাহিন বলতে লাগল ভূত ছাড়ানো হচ্ছে- না? আর তোমাদের তামাশা দেখা হচ্ছে? যাও যাও সবাই চলে যাও। আমার বোনের ভূত আমি ছাড়াবো যাও, সবাই চলে যাও। মাহিনের চেঁচামেচিতে সবাই চলে গেল। ওঝা বেটাও গেল তবে তার ভড়ক দেখানোর মূল্য নিয়ে। বোনকে পাশে বসিয়ে মাহিন জিজ্ঞেস করল- তোর এ অবস্থা কেমনে হলো, টুনি? ভাইকে পাশে পেয়ে টুনি সাহস ফিরে পেল। সে বলতে লাগল- কাল রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় উঠানে বসে শরতের সুন্দর চাঁদ দেখছিলাম। এসময় আমাদের ঘরের পেছনের ওই ডুমুর গাছটায় একটা বাদুড় এসে বসল। ডুমুর ফল খেতে খেতে বাদুড়টা ককিয়ে উঠল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম বাদুড়টা কিসে যেন আটকে গেছে। দেরি না করে আমি গাছে উঠলাম। দেখি কি ডালে পেঁচানো একটা সুতোয় বাদুড়ের পাখা আটকে গেছে। বাদুড়টাকে ছাড়িয়ে দিলাম। ততক্ষণে মা ডাকলেন। গাছে থাকা অবস্থায় মার ডাকে সাড়া দিলাম। মা ধমকিয়ে গাছ থেকে নামালেন। আমি নামলাম। মা ভূতের ভয় দেখালেন, বললেন- ডুমুর গাছে রাতে ভূত থাকে আর সে গাছে উঠেছিস? গাছে ওঠার কারণে আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে আমার শরীরে জ্বর এলো। সারাদিন শুয়ে রইলাম। রাতে বিছানা থেকে তুলে এনে ওঝা বেটা আমাকে সাপ দিয়ে ভয় দেখাতে লাগল। এই বলে টুনি জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। ও, এই কথা! তোমাদের যে আর কবে বুদ্ধি হবে মা! ফোন করে সব কথাই বলো, টুনির জ্বরের কথা একবারও তো বলোনি মা। টুনি, শোন- এ জগতে ভূতটুত বলে কোনো কিছুই নাই। যা দেখবি সবি বাদুড়, বাদুড় ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সাপ দিয়ে তোকে যারা ভয় দেখালো তারা সবাই বাঁদর। বোনকে আরও নানা কিছু বুঝ দিয়ে শহর থেকে আনিত সে পত্রিকার দৃশ্য দেখিয়ে বলল- দেখ কত সুন্দর দৃশ্য। আমি দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি তোকে সঙ্গে নিয়ে বাস্তবে এ দৃশ্যগুলো দেখব। তুই আমার সঙ্গে থাকবি তো? টুনি মুখে শব্দ না করে ঘাড় নেড়ে সম্মতির জানান দিল শুধু।