আগুনদৈত্য

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সারমিন ইসলাম রত্না
আজকাল মনটা বড্ড খারাপ থাকে রওনকের, রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা খুললেই শুধু আগুন লাগার খবর। ওর ভালো লাগে না কিছুই, পড়াশোনায় মন বসে না। মনটা সারাক্ষণই ছটফট করতে থাকে। আর মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকে নানারকমের প্রশ্ন। কেন এত আগুন? মানুষ এত অসাবধান হলো কি করে? ওদের বাসায় গ্যাসের চুলা আছে, মা অপ্রয়োজনে সেটাকে জ্বালিয়ে রাখেন না। বাবা আর ছোট বোনটাও সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে। রাজধানীর বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোতে আগুন লাগার পর ওদের সবার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে, সেই ভয়ের নাম আগুন। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা রওনক। জানালা খুলে রাখে। আর তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ওর কানের কাছে কেবল চিৎকার ভেসে আসে। আগুন আগুন! বাঁচাও বাঁচাও! শেষরাতের দিকে একদিন চোখদুটো বুজে এলো রওনকের, হঠাৎ ও ভীষণ গরম অনুভব করতে লাগল। চোখ মেলে তাকাল রওনক, আঁতকে উঠল। একি! তার সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। রওনক ভয়ে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল, আগুন রওনককে বলল, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন হা হা হা তাই না? রওনক খুব সহজ গলায় উত্তর দিল, হঁ্যা। কিন্তু তুমি কীভাবে জানো? আগুন অট্টহাসিতে ফেটে পরল। হা হা হা! আমি জানি। তোমার মনে যতরকমের প্রশ্ন আছে সবকিছুর উত্তর আমি জানি। তাহলে বলো কেন তুমি এত খেপেছ? কেন তুমি এভাবে সবাইকে পুড়িয়ে মারছো? আগুন চারদিকে ছড়াতে ছড়াতে তার গনগনে কণ্ঠে বলে উঠল, পাপ আর অনাচারে ভরে গেছে দেশটা। শুধু তাই নয়, পৃথিবীটাও। কিছু কিছু মানুষ আজকাল এমন আচরণ করছে, তাদের দেখে মানুষ বলেই মনে হচ্ছে না। তারা নিজেরা তো পাপ করছেই আমাকে দিয়েও পাপকাজ করাচ্ছে। হোটেলে হোটেলে, রাস্তায় রাস্তায় আমাকে দিয়ে ভেজাল খাবার তৈরি করছে, নানারকম বিষাক্ত পদার্থ মেশাচ্ছে ওইসব খাবারে। আমার অবাক লাগে, মানুষ কি করে এতটা খারাপ হতে পারে! তাই আমি প্রচন্ড খেপেছি প্রচন্ড। হা হা হা আমি সবাইকে পুড়িয়ে মারব! রওনক বলল, থামো, আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তাই তো তোমার কাছে আমার মনের কথা বলতে এসেছি। শোনো রওনক আমি কাউকেই ছাড়ব না। কিন্তু তুমি নির্দোষকে কেন পুড়িয়ে মারবে? কাদের তুমি নির্দোষ বলছ? যারা মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করে তাদের? নাহ রওনক নাহ। যারা অন্যায় করে আর যারা মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করে উভয়ই আমার কাছে সমান দোষী। রওনক প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে উঠল, তুমি জানো না সুদিন আসবেই। কখনো না। হা হা হা কখনো না। আগুন হাসতে লাগল, তার হাসির তোড়ে কাঁপতে লাগল সমস্ত ঘর। রওনক প্রচন্ড খেপে গেল, সে আগুনকে ধরার জন্য হাত বাড়াল। যেন এক্ষুনি আগুনকে বন্দি করে ফেলবে। আগুন বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে, তারপর পাক খেতে খেতে উঠে গেল উপরে। একেবারে দশতলার একটি বিল্ডিংয়ে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল আগুন, শুরু হলো মানুষের চিৎকার। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আগুনে ভরে উঠল আকাশ, মানুষের কান্নায় ভারী হলো বাতাস। রওনক জানালায় দাঁড়িয়ে অনুনয়ের সুরে বলল, আগুন বন্ধ করো তোমার ধ্বংসলীলা। পুড়িয়ে মেরো না ওদের। কিন্তু আগুন রওনকের কথা শুনলো না, বরং একটার পর একটা পোড়াতে লাগল ঘর-বাড়ি, বিশাল বিশাল শপিং মল। রওনক ভাবল আর বসে থাকা যায় না, কিছু একটা করতেই হবে। রওনক পরের দিনই তার সব বন্ধুকে ডাকল এবং বলল, দয়া করে তোমরা সচেতন হও, আগুন অনেক মূল্যবান একটা জিনিস। যা ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রায় অসম্ভব। অথচ আজ এই আগুন আমাদের জন্য মৃতু্য নিয়ে এসেছে। কারণ আমরা নিজেরা পাপ করছি, তাকে দিয়েও পাপ কাজ করাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃতির সবকিছুই একদিন আমাদের উপর খেপে যাবে, আর ধ্বংস করে দেবে। অতএব, এগিয়ে আসতে হবে আমাদের, পৃথিবী থেকে দূর করতে হবে পাপাচার। সবাই রওনকের হাতে হাত রেখে একাত্মতা ঘোষণা করল। ওরা সেদিন থেকে সেই মুহূর্ত থেকেই, ওদের পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীকে সচেতন করে তুলল। তারপর রওনকের সঙ্গে হাজার হাজার লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী নেমে পড়ল রাস্তায়। ওরা দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিল পোস্টার, ওদের হাতে হাতে ব্যানার-ফেস্টুন। আর কণ্ঠে শুধু একটাই স্স্নোগান, 'পাপ অনাচার বন্ধ করো একটা নতুন পৃথিবী গড়ো'। রাতে যে যার ঘরে ফিরে গেল। কিন্তু রওনকের চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ প্রচন্ড ধোঁয়া উঠল, গরম নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ঘরে ঢুকল আগুন, এদিক-ওদিক তাকিয়ে শরীরটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল, রওনক তুমি তোমার ভাবনাটাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে চাও? রওনক বলল, হঁ্যা চাই। তুমি পারবে না, হা হা হা তুমি পারবে না। রওনক বলল, আমি পারব। শোনো রওনক, যখনই তুমি ভালো কিছু করতে চাইবে তখনই হিংসার আগুন আর লালসার আগুন তোমাকে ছাই করে দেবে। হঁ্যা দেবে, কিন্তু আমি ভয় পাই না। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই করব। তবে তোমার প্রতি চ্যালেঞ্জ রইল। রওনক আগুনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, চ্যালেঞ্জ। আগুন রওনকের দিকে তাকিয়ে একটা আলোকিত হাসি দিল। তারপর বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে।