শিশুতোষ গল্প

ওদের কোনো দুঃখ নেই

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সাঈদ নিশান
সকাল হলেই ওরা নেমে পড়ে কাজে। একজন শপিংমল, কাঁচাবাজার, অফিসপাড়া, ফুটপাত, ক্লাব, পার্ক, খেলার মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পস্নাস্টিকের খালি বোতল কুড়ায়। আর অন্যজন বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে ফেলে দেয়া পুরনো ভাঙাচোরা জিনিসপত্র টোকায়। পস্নাস্টিকের বোতল কুড়াতে কুড়াতে 'বোতল' আর ফেলনা জিনিস টোকাতে টোকাতে 'ফেলনা'- এ নামেই সবাই ওদের ডাকে। ওরা এসব কুড়িয়ে বস্তা ভরে ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করে। যা পয়সাকড়ি আসে তা দিয়েই ওদের দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোগাড় হয়ে যায়। আজ দুপুরে চারটা আটার রুটি ও দুই পলি বুটের ডাল কিনে নিয়ে ওরা সোজা গিয়ে বসল পার্কের এক কোণায়, গাছের ছায়ায়। খাবার খেতে খেতে ফেলনা বলল, 'বোতল, তোর থাইক্যা আমি রোজ কম টোকাই। কিন্তু খাই সোমান সোমান। আমারে কম দিলেও তো পারস।' ফেলনার কথা শুনে বোতল খাওয়ায় বিরতি দিয়ে বলল, 'কী কস ফেলনা? আমার যেমন খিদা লাগে, তোরও তো হেমন ...।' এবার একটু হাসি মিশিয়ে বোতল বলল, 'তুই যহন বেশি কামাবি তহনও আমরা সোমান সোমান খামু। বুঝছস, অহন খা।' বোতল-ফেলনা দুজনাতে দারুণ মিল। তাদের এমন মিল দেখে কাগজকুড়ানি মাজুর রীতিমতো হিংসে হয়। একদিন তো বলেই ফেলল, 'এই তগো মধ্যে কি রক্তের সম্পর্ক?' মাজুর কথার উত্তরে বোতল বলেছিল, 'জানি না, তয় ফেলনার লাইগা অনেক মায়া লাগে।' ফেলনার প্রতি যে বোতলের এ রকম টান, ফেলনা তা বুঝতে পারে। ফেলনারও বোতলকে ছাড়া নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। হাতেগোনা কয়েকটি অলিগলি বাদে এ শহরের পুরোটাই যে তার অচেনা। বোতল পাশে থাকলে তাই সে অনেকটা ভরসা পায়। টোকানোর সময়টা বাদে ওদের দুজনকে একসাথেই দেখা যায়। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ঘোড়ার গাড়ি, দোতলা বাস, ক্যানভাসারের রংতামাশা, সিনেমার পোস্টার, রাস্তার ধারে টানানো বিলবোর্ডের বড় বড় ছবি- এসব দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় নিয়ন বাতির আলো, কমিউনিটি সেন্টারের বর্ণিল আলোকসজ্জা দেখেও ওরা অন্যরকম আনন্দ পায়। এ ছাড়া বাজারের সমিতিঘরে সদস্যদের চা-নাশতা এনে দিলে টিভি দেখার সুযোগ হয়। তখন কার্টুন ছবি দেখে ওদের কিছুটা সময় কেটে যায়। রাত বাড়লে হকাররা সাজানো পসরা ভেঙে দেয়, কর্মজীবীদের হাঁটাচলা কমে যায়, তখন ওরা ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়ে। বৃষ্টিবাদল হলে কোনো ভবনের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। এভাবেই কাটে ওদের দিনরাত। বোতলের বয়স দশ কি এগারো আর ফেলনার আট কি নয় হবে। বছর দুই আগে কুড়াতে গিয়ে বুড়িগঙ্গার ধারে ফেলনাকে আবিষ্কার করেছিল বোতল। ডাস্টবিনের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ফেলনা। পথচারী কেউ কেউ তা লক্ষ্য করলেও তার কান্নার উদ্দেশ্য জানার আগ্রহ কারও মধ্যে ছিল না। শুধু বোতলই এগিয়ে এসেছিল। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এরপর তার পাশে এসে বসল। খুব দরদ দিয়ে বলল, 'তর লগে কেউ নাই?' অচেনা কাউকে পাশে এসে বসতে দেখে ফেলনা ঘাবড়ে গেল। সেই সাথে কান্নাও থেমে গেল। কথা বলার মতো সাহসও যেন হারিয়ে ফেলেছে ফেলনা। কোনো উত্তর না পেয়ে বোতল আবার জিজ্ঞেস করল, 'তর মনে কী দুঃখ? আমারে খুইলা ক। আমি তর মতনই ...।' প্রায় সমবয়সী বোতলের এবারের কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল ফেলনা। মনে হলো বোতলকে তার নিজের কথা বলতে পারলে কিছুটা হালকা লাগবে। ফেলনা যখন একটু একটু করে হাঁটতে শিখল তখন তার বাবা মারা যায়। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হলে দেখাশোনার দায়িত্ব নেয় তার নানি। নানি গ্রামের অবস্থাপন্ন গেরস্ত বাড়িতে কাজ করত। ফেলনাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে যেত। নানি সারাদিন কাজ করে যে খাবার পেত তা নাতনিকে নিয়ে খেত। এভাবেই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদে নানিকে বাতের রোগে পেয়ে বসে। কোমরে ব্যথা, চোখে কম দেখা- এ রকম সমস্যায় ওই বাড়িতে নানির কাজ করাও বন্ধ হয়ে গেল। মামার সংসারে বোঝা হয়ে উঠল দুজন। অবশেষে শিশু ভাগ্নিকে কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। একদিন মামা ভালো কাপড়-চোপড় পরিয়ে ফেলনাকে লঞ্চে তুলে দিয়ে বলল, 'এই লঞ্চ তোরে শহরে নিয়া যাইবো। যেহানে লাল-নীল বাতি জ্বলে। কোনো পেক-কাদা নাই। কামের অভাব নাই, খাওনেরও অভাব নাই। ভালাই থাকবি।' বলতে বলতে ফেলনা আবার কাঁদতে শুরু করল। বোতল ফেলনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, 'কান্দিস না। কাইন্দা কী অইবো! তর তো বাবা-মা আছিল। মনে কইরা দুঃখ পাছ। আমার হেইডাও নাই। তাই কোনো দুঃখও নাই।' এবার বোতল দাঁড়িয়ে একটা হাত ফেলনার দিকে বাড়িয়ে বলল, 'চোখের পানি মুইছা আমার হাতটা ধর। দেখবি তরও আর কোনো দুঃখ থাকব না।' \হ