শিশুতোষ গল্প

অন্য বিজয়

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মিতুল সাইফ
'জব্বার স্যারের ক্লাস তখনো শেষ হয়নি। এই ক্লাসটা হয়ে গেলেই স্কুল ছুটি। আমরা তাই ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করেই পাক-সেনাদের অতর্কিত আক্রমণ। নির্বিচারে একটানা গুলি করে নির্মমভাবে ঝাঁজরা করে দেয়া হলো শিক্ষক মিলনায়তন। শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের গগনবিদারী আর্তনাদ কানে আসতেই ক্লাস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন স্যার। সিঁড়ি ঘরের কাছে যেতেই তার সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেল। তারপর যত্রতত্র এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে চলে গেল পাক মিলিটারিদের লরি। ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আহত হলো। শহীদ হলেন জব্বার স্যার, সুবর্ণা ম্যাডাম আর স্কুল দপ্তরি নকুল।' এটুকু বলেই আমান মামা থামলেন। তার দুই চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে লাগল। মামা আর কথা বলতে পারলেন না। আমরা যারা শুনছিলাম তারাও চোখ ভিজিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আমান মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র, স্কুলের ওই ঘটনার পরেই বন্ধুরা মিলে ভারতে ট্রেনিং করে এসেই যোগ দেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করেন মামা। নিজের বলতে আর কেউ বেঁচে নেই। মা-বাবা আর একমাত্র ছোট বোন মক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মামি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। আমরা সময় পেলেই মামার কাছে গিয়ে নানা গল্প শুনতাম। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের। কিন্তু মামা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে প্রায়ই থেমে যান, তার চোখ ভিজে আসে। পুরো ঘটনাটা আমাদের আর শোনা হয় না। আমাদের পাড়ার কিংবা স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে মামাকে কখনো দেখা যায়নি। আমন্ত্রণ জানালেও বিনয়ের সঙ্গে মামা সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রম্নয়ারির অনুষ্ঠানেও মামা অনুপস্থিত। রোববার স্কুল ছুটির পর আমি মৌলি, আর তৌফিক- মামাকে গিয়ে ধরলাম। এবার বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তোমাকে থাকতেই হবে। তুমি থাকবে বিশেষ অতিথি। প্রধান অতিথি সাত্তার আলী চেয়ারম্যান। প্রধান অতিথির নাম বলতেই মামার চোখ লাল হয়ে গেল। দ্রম্নত শ্ব্বাস নিতে নিতে মামা বললেন, ওই জানোয়ারটা ছিল পাক-বাহিনীর দোসর বেইমান রাজাকার। ওই মেরেছে আমার মা-বাবাকে। বোনটাকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে। আর বারবার তোরা ওকেই ভোট দিয়ে মালা পরিয়েছিস। চোখের সামনে ওই খুনি লম্পট বেইমানটা মালা গলায় বসে থাকলে বল আমি কি করে সেখানে যাই। ইচ্ছে করে সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিই। এক্ষুনি আমার সামনে থেকে যা তোরা। মামাকে এরকম রণমূর্তি আগে দেখিনি, তাই আমরাও আর কিছু না বলে ফিরে এলাম। তৌফিক বলল, আমাদের কি কিছু করার নেই? সবাইকে খবর দে। আজ বিকেলেই স্কুল মাঠে সব সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জরুরি সভা। বিজয়ের অনুষ্ঠানে কিছুতেই আমরা রাজাকারের গলায় মালা দেবো না। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছির আমান। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সবাইকে খবর দিতে দারুণ সাড়া মিলল। বিকালে মিটিং সেরে একই দাবি নিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হলো প্রধান শিক্ষক, নির্বাহী অফিসার, স্থানীয় থানা ও সংসদ সদস্য বরাবর। সারা এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল এই একই দাবি। সবার দাবির মুখে ঠিক হলো রাজাকার সাত্তার আলীকে বাদ দিয়েই হবে বিজয়ের অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি থাকবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছির আমান। ভাব-গতি খারাপ দেখে সাত্তার আলী আর তার সাঙ্গপাঙ্গ এলাকা ছাড়ল। \হআমরা হাসিমুখে অনুষ্ঠানের কার্ড আমান মামার হাতে দিতেই আনন্দে কেঁদে ফেললেন মামা। বললেন, এ আমাদের অন্য বিজয়। মহান বিজয়ের মাসে এ আমাদের আর এক বিজয়।