ফুলবন্ধু

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মাসুম বিলস্নাহ
ভুটু এলো শহরে। সঙ্গে বাবা। যাচ্ছে বড় ফুফুর বাসায়। আদাবর। স্কুল ছুটি। ফুফুর ছোট ছেলে মর্মর। সমবয়সি। ক্লাস সিক্স। তার নিজের নামটাও তো অদ্ভুত-ভুটু! ও শুনেছে, ওদের একটা বিশাল ভুট্টার ক্ষেত ছিল, বাবা ভুট্টা বেশ পছন্দ করত। ছেলের নাম রেখেছিলেন ভুট্টার সঙ্গে মিলিয়ে-ভুট্টু। শেষে ভুট্টু থেকে ভুটু হয়ে গেছে। সে বাবার কাছে জানতে চায়, আব্বা, ফুফুগে লাল গাড়িতি আমারে চড়তি দেবেনে? বাবা বলেন, দেবে না ক্যান! দেবেনে। ভুটু মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, বড় হয়ে সে একটা গাড়ি কিনবে, তবে লাল নয়, দুধসাদা গাড়ি। এবার সে জোরগলায় বাবার কাছে জানতে চাইল-ও আব্বা, গাড়ি জোরে চলতিছে না ক্যান? বাবা বলেন, জাম লাগিছে, কড়া জাম! ঢাকা শহরে গাড়ি দৌড়াতি পারে না, হাঁইটে হাঁইটে চলে! ভুটুর অস্থির লাগে। সে সিদ্ধান্ত পাল্টে নেয়, গাড়ি কিনবে না, একটা দুধসাদা ঘোড়া কিনবে। তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াবে। সে বাবাকে প্রশ্ন করে, ও আব্বা, একটা ঘোড়ার দাম কত হবেনে? বাবা হেসে বলেন, ঘোড়ার তো ম্যালা দাম বাজান। ভুটু আর কিছু বলে না। বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইল। বাবা বুঝলেন, ছেলের মন খারাপ হয়েছে। বললেন, জানিস, ল্যাংটা থাকতে তুই একবার ঢাকা আইসেছিলি। ভুটু লজ্জা পেল। বলে, আব্বা, তোমার কোনো শরম নাই? বাবা ছেলের গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলেন, নিজের ছাওয়ালের কাছে আবার শরমের কী! হা হা। বাস থেমে আছে শিশু পার্কের সামনে। বাসের মধ্যে একটা লোক পানির বোতল হাতে চিৎকার করে বলছে-এই দিমু দিমু ঠান্ডা পানি, পানি পানি... এরপর একটা ছোট ছেলে এসে বলল, আমড়া আমড়া লন, ঝাল, মরিচ, লবণ দিয়া আমড়া... ভুটু ভাবতেও পারেনি আমড়া এভাবে কেটে পলিথিনে করে বিক্রি করা যায়! বাবা বলেন, তোর আমড়া খাতি ইচ্ছে করতিছে? খাবি? ভুটু মাথা নাড়ে। খাবে না। আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল গুলিস্তান থেকে আদাবর আসতে। ভুটুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে আর শহরে আসবে না। বাসায় ফুপা একা। ফুফু আর মর্মর বাইরে গেছেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। বাবা আর ফুপা কথা বলে চলেছেন। ভুটুর মোটেও ভালো লাগছে না। অথচ ঢাকায় আসতে সে-ই জোর করেছে। সে মর্মরের রুমে এলো। জীবনেও এত সুন্দর ঘর দেখেনি। অথচ তার একটা কাঠের টেবিল আর একটা নড়বড়ে কাঠের চেয়ার। ভুটু জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছা করছে মাথা বের করে দিতে, কিন্তু লোহার গ্রিলে বাঁধা পড়ল। চারপাশে সারি সারি দালান। ভুটু বিড় বিড় করে- খালি দালান আর দালান বানাচ্ছে... গাছ নেই, পাখি নেই, ধান ক্ষেত নেই, পুকুর নেই... সে চোখ বন্ধ করে। সে একটা নদীর ছবি আঁকে। দেয়ালে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। ভুটু চোখ মেলে টিকটিকিটাকে খুঁজল। দেয়াল ঘড়ির পেছনে মাথা বের করে ভুটুকে দেখছে। সে এগিয়ে গেল। চোখে চোখ রেখে বলল, মাই নেম ইজ ভুটু, ভুটু হাওলাদার, কেম ফরম ভিলেজ...ওকে? টিকটিকিটা টিক টিক করে ওঠে। ভুটু খুশি হয়। বলে, আমাগে ইশকুল বন্ধ, ফুফুর বাড়ি বেড়াতে আইসেছি, বুঝতি পারিছো? টিকটিকিটা চোখ নাচালো। তারপর টিক টিক করে উঠল। ভুটু আবার কিছু বলতে যাবে তখন পেছন থেকে মর্মর বলে ওঠে, তোমার নাম ভুটু, অ্যাম আই রাইট? ভুটু বলে, তুমি হচ্ছো, মর্মর! -সরি? মর্মর চোখ কুঁচকিয়ে বলল। -মর্মর বলেছি, মর্মর, আমরা ম্যালা সময় আগে আইসেছি... -ওহ্‌ ইয়েস ব্রো, আন্টির বাসায় গিয়েছিলাম, কাজিনের মোবাইলে জোস জোস গেমস্‌ আর অ্যাপস্‌ আছে, সেগুলো আনতে... এসো তোমাকে দেখাই... ভুটু আগামাথা কিছুই বুঝল না। সে নড়ল না। তার খিদে পেয়েছে। সে বলল, ভাত খাতি দেও! ভুটু বিছানায় এসে বসল। তারপর কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে এক পেস্নট ভাতের ছবি আঁকলো। এসময় ফুফু এলেন রুমে। বলেন, ভুটু যে অনেক বড় হয়ে গ্যাছো। মর্মর ভুটুকে নিয়ে খাবার টেবিলে এসো। ভুটু মনে মনে খুশি হলো। খাওয়া শেষ করে আবার মর্মরের সঙ্গে ফিরল। রাতে মর্মরের সঙ্গে ঘুমাবে। রুমে এসেই ভুটু মনে করার ভঙ্গিতে মর্মরকে বলল, তোমার জন্যি একটা জিনিস এনেছি...দাঁড়াও, নিয়ে আসতেছি... ভুটু ছুটে গেল বাবার কাছে। ফিরেও এলো দ্রম্নত। হাত পেছন থেকে সামনে এনে বলল, এই যে নেও... মর্মর অবাক হয়ে বলল, কী এটা? -ফুল। আমার প্রিয় ফুল। -কী ফুল? -মাদার গাছের ফুল। -জীবনে এ ফুল আমি দেখিনি, এ ফুলও আবার কারও প্রিয় হয়! এই প্রথম দেখলাম। ভুটু কিছু বলল না। তার মন খারাপ হলো। সকালে গাছ থেকে ছিঁড়ে ব্যাগের ভেতর রেখেছিল। ভেবেছিল মাদার গাছের ফুল দেখে মর্মর অনেক খুশি হবে। কী সুন্দর টকটকে লাল ফুল। কিন্তু... মর্মর বলল, তুমি মোবাইলে গেমস্‌ খেলতে পারো? ভুটু মাথা নেড়ে বলে, আমাগে মোবাইলে খালি কথা কওয়া যায়। মর্মর অবাক হয়। বলে, এসো, তোমাকে শিখিয়ে দিই। ভুটু বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে। মর্মর চোখ পিট পিট করে বলে, এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমায়! ভুটু কিছু বলল না। মর্মর মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলো। নতুন বিছানা। নতুন জায়গা। তার ইচ্ছে করছে বাবার কাছে যেতে। বাবার সঙ্গে ঘুমাতে। বিছানায় উঠে বসল। মর্মর এখনো ঘুমায়নি! মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে। সে চোখ বন্ধ করল। অনেকগুলো জোনাক পোকার ছবি আঁকল। কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙল ভুটুর। মর্মর এখনো ঘুমোচ্ছে। টেবিলের ওপর মাদার গাছের লাল ফুলটি শুকিয়ে এসেছে প্রায়। দেখে মন খারাপ হলো। তার ইচ্ছে করছে বাইরে যেতে। কিন্তু শহরের কিছু চেনে না। একা একা বের হতে সাহস করল না। সকাল ১০টায় চোখ মেলল মর্মর। দুপুর হয়ে এলো। ভুটুর মোটেও ভালো লাগছে না। শেষে মর্মরকে বলে ফেলল, চলো, খেলার মাঠে যাই। মর্মর বলল, এখানে মাঠ পাবে কোথায়? ভুটু অবাক হয়। বলে, একটাও মাঠ নেই! তোমরা কোয়ানে খ্যালো? -মাঠে যাওয়ারই তো সময় পাই না! স্কুল, কোচিং, বাসার টিউটর... -ও। তোমাগে বুঝি অনেক পড়তি হয়! এত পড়তি ভালো লাগে তোমার? -মোটেও ভালো লাগে না, তাও পড়ি। -আমারও তোমাগে শহর ভালো লাগতিছে না, বাড়ি চইলে যাব... -কি বলছো তুমি! -সত্যি কচ্ছি, এহনি চইলে যাতি ইচ্ছে করতিছে...তুমি আমাগে সাথে যাবা? -তুমি বাবা-মাকে রাজি করাতে পারলে আমার আপত্তি নেই...আমারও আর বাসার মধ্যে মোবাইলের গেমস্‌ খেলতে ভালো লাগে না... -চলো, ফুফুরে গিয়ে কচ্ছি... -চলো... ভুটু ফুফুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কথাটা বলতে তার ভয় লাগল। ফুফু বললেন, কীরে, কিছু বলবি? ভুটু মাথা নাড়ল। মর্মররে আমাগে গ্রামে নিয়ে যাবো, মর্মরও যাতি চাচ্ছে... ফুফু বললেন, আগে তোর বেড়ানো শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে। -ফুফু, আমার শহরে বেড়াতি ভালো লাগতিছে না, বাড়ি চইলে যাবো, মর্মরও আমাগে সাথে যাবে। -তোরা দুজনে মিলে বুঝি এই বুদ্ধি বের করেছিস! আচ্ছা, ঠিক আছে, তোর ফুফার সঙ্গে কথা বলে নিই। বিকেলে বাসার ছাদে এলো ওরা দুজন। মর্মর বলল, আকাশ পছন্দ তোমার? ভুটু মাথা নেড়ে বলে, হু, কিন্তু তোমাগে শহরের আকাশ আমাগে মতো সুন্দর লাগতিছে না। ভুটুর কথায় হো হো করে হাসল মর্মর। হাসি থামিয়ে বলে, তোমাদের গ্রামে আর কি কি সুন্দর জিনিস আছে? -আমাগে গ্রামটাই সুন্দর, পুকুর সুন্দর, গাছ সুন্দর, আমাগে বাড়ির মুরগি, কবুতর সুন্দর, দোয়েল পাখি, হলদে পাখি সুন্দর...মাদার গাছের লাল ফুল সুন্দর! -আচ্ছা, আচ্ছা, কিন্তু গ্রামে গিয়ে আগে তোমার মাদার গাছের লাল ফুল দেখাবে। -আচ্ছা, দেখাবানি। ভুটু মনে মনে খুব খুশি হয়। মর্মরের পড়ার টেবিলে লাল ফুলটি এখনো পড়ে আছে। ভুটু ফুলটি হাতে তুলে নিয়ে চমকে উঠল। তারপর চিৎকার করে মর্মরকে ডাক দিল। ছুটে এলো মর্মর। বলল, কী হয়েছে, ভুটু? ভুটু উত্তেজিত হয়ে বলল, দেখতিছো ফুলডা কিরাম তাজা! মনে হচ্ছে, এহন ছিঁড়িছি। মর্মর ফুলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, তাই তো! এটা কী করে সম্ভব? ওরা দুজন চিন্তায় পড়ল। কিন্তু ভেবে পেল না কিছু। শেষমেশ দুই ভাইকে চিন্তামুক্ত করল মাদার গাছের লাল ফুলটি। ফুলটি গলা ঝেড়ে বলল, এই যে গ্রামবাবু এই দিকে...এই যে শহরবাবু এই দিকে... দুই ভাই ফের চমকে উঠল। রুমের ভেতর ইতিউতি খুঁজলো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এবার জোর ধমক দিল লাল ফুলটি। বলল, এই যে এদিকে...টেবিলের ওপর... মামাতো ভাই, ফুফাতো একসঙ্গে পড়ার টেবিলের কাছে ছুটে এলো। ফুলটি ওদের দিকে চেয়ে বলল, অবাক হচ্ছো কি জন্যি ভাইডি? আমি কতা কচ্ছি। শহরে আইসে মইরে যাচ্ছিলাম আরেকটু হলি। তোমাগে ধন্যবাদ, তোমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিছো। আমারও এই শহরে মোটেও ভালো লাগতিছে না। চলো, আমরা গ্রামে চইলে যাই! ভুটু ও মর্মর ফুলটা হাতের তালুতে তুলে নিল। তারপর দুজন একই বলল-আমরা আজকেই এ শহর ছেড়ে চলে যাবো, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, বন্ধু, ও ফুলবন্ধু!