তোমাদের জন্য

নজরুলের শিশুতোষ গানে শিশুমনের ভেলা মীম

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মিজান
কাজী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তাকে সবাই বিদ্রোহী কবি বলে জানি। তার নাম কিন্তু দুখু মিয়া ছিল। যখন তিনি কিশোর ছিলেন তখন সবাই তাকে দুখু মিয়া নামে ডাকত। আর এই দুখু মিয়া তার কবিতাতে দুঃখী মানুষের কথা লিখেছিলেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন শোষকদের বিরুদ্ধে। তবে তার কলম শুধু বড়দের জন্য কবিতা বা গান লিখেই ক্ষান্ত হয়নি বরঞ্চ শিশুদের জন্য মনকাড়া অনেক ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটক ও গান লিখেছিল। দুখু মিয়ার শিশুতোষ গানগুলো সত্যিই মনকাড়া। তার ছড়া-কবিতা পড়ে যেরকমটি আমরা মজা পাই ও নিজের ভিতর ধারণ করি তেমনটি তার শিশুতোষ গানগুলোও নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে যাই। গানের কথার মানুষ বনে যেতে চাই। নিজেকে উড়িয়ে নিতে চাই পরীস্থানের পরীদের সঙ্গে। ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় ঝলমলে কোনো ভেলায়। শিশুদের মন যেমন কাদামাটির মতো নরম তেমনি কল্পনাবিলাসী। কল্পনা করে পরীস্থানের পরীদের সঙ্গে করবে ওড়াউড়ি। গাইবে গলা ছেড়ে গান। হাতে থাকবে জাদুর কাঠি বা তারকার ছড়ি। গায়ে থাকবে চকমকে পোশাক। আবার অনেক সময় ভাবে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানো প্রজাপতি হবে। এরকম কত্ত ভাবনার গীত উদয় হয় শিশুর মনে। তাদের সামনে যখন কোনো প্রজাপতি পড়ে তখন স্বপ্নের প্রজাপতির মতো মনে হয় সেগুলোকে। তাই গানের সুরে সুরে জিগ্যেস করে- 'প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই! এমন রঙিন পাখা। টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা কোথায় পেলে এমন রঙিন পাখা।' আমাদের শিশুরা যেন আগামীর বীর সেনানী হয়। তারা যেন হয় অকুতোভয়। তাদের মনে যেন জন্মে অসম সাহস। তারা যেন ভিনদেশি প্রভুর কোনো কথা না শুনে। বিভুঁই থেকে আসা বেনিয়াদের উৎখাত করতে যেন নিজেকে দাবানলে করে পরিণত। তাই তো শিশুমনের ভেলাচালক দুখুমিয়া গেয়ে উঠলেন 'চল চল চল' নামক উদ্দীপনাপূর্ণ সংগীতে- 'চল চল চল!/ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণিতল,/অরুণ প্রাতের তরুণ দল চল রে চল রে চল।/ চল চল চল আমরা যদি দেশের তরে প্রাণ বিলাই, সত্যের তরে উৎসর্গ করি নিজেকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যদি হই শহিদ তবে হবো অমর। সব মানুষের কাছে হব শ্রদ্ধেয়। তাই মৃতু্যর ভয় মাড়িয়ে যাব। তবেই না সূয্যিমামা জানাবে স্নেহ। নজরুল শিশুদের নিজদেশের বিষয়ে জানিয়েছেন। নিজের এই শস্য-শ্যামলা দেশ যে অন্য সব দেশের থেকে আলাদা তাও গানের সুরে সুরে বুনেছেন। বাংলাদেশের প্রকৃতির মনোহরা ডাক ও স্নেহ পৃথিবীখ্যাত। তাই তো কবির দরাজ কণ্ঠ গেয়ে উঠল- 'একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পলস্নী-জননী। ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী' আমার এই বাংলার মাঠ-ঘাট কীরূপ বৈচিত্র্যময় তাও গানের কবি নজরুল শিশুদের জানাচ্ছেন এভাবে- ধানের ক্ষেতে বনের ফাঁকে/ দেখে যা মোর কালো মাকে ধূলি-রাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিনী বীন বাজায়' আমাদের দেশ সবার থেকে আলাদা ষড়ঋতুর এক চমৎকার দেশ। গরমের রূপ, রস পাই দরদরে ঘামঝরা বোশেখ মাস ও জ্যৈষ্ঠ মাসে। তারই এক সংগীত বন্দনা শুনাচ্ছেন শিশুদের প্রিয় নজরুল- 'মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে তৃষ্ণার কাতর চাতকী ডাকে' খরতাপের গ্রীষ্মের পর ঝরোঝরো ধারার বরষার আগমন ঘটে বাংলার বুকে। থই থই জলে ভরে যায় খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ইত্যাদি। শিশুরা গোসল করে বৃষ্টির পানিতে। ভেলা সাজিয়ে ঘুরে বেড়ায় নতুন জলে। শিশুদের সে বারতাও জানালেন কবি। এরকম বরষার টানা বর্ষণের দারুণ চিত্র এঁকেছেন বাবরি দোলানো গায়ক কবি নজরুল। থই থই জলের বরষার পরে আসে সাদা মেঘ, কাশফুল, শিশিরে নোয়ানো ঘাসের ডগা, শিউলি আর পালতোলা নৌকোর কাল শরৎ। জোসনাময় রাত, ঝোপঝাড় পূর্ণ জোনাকি ইত্যাদি শিশুদের কতই না ভালো লাগে! শরতের পরেই ম-ম গন্ধের হেমন্ত আসে খানিক শীতের বারতা নিয়ে। জলে ভেসে থাকে কুমুদ বা পদ্ম। গ্রামে চাষির মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি। নাইওর যায় রমণীরা। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কোলে বা হাত ধরে নানার বাড়ি যায় শিশুরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে নতুন ধান ঘরে তুলতে আনন্দও পায় শিশুরা। এরকম হেমন্তের বর্ণনায় বাঙ্ময় বাংলাদেশের জাতীয় কবির গায়ক কণ্ঠ। 'হৈমন্তিকা' নামক শিশুতোষ সংগীতে গাইলেন তাই- 'আমন ধানের ক্ষেতে জাগে/ হিলেস্নাল তব অনুরাগে, তব চরণের রং লাগে/ কুমুদে রাঙা কমলে' আমাদের শিল্পীকবি শীতের কাঁপুনি বা উষ্ণ কম্বলের ওমও গেঁথেছিলেন ছোটদের গানে। ঋতুরাজ বসন্তের সরব উপস্থিতিও শিশুদের তার গানের প্রতি করে আগ্রহী। কোকিলের কুহুতান। গাছে গাছে নতুন কচিপাতা। হরেক রঙের হরেক ফুলের সমাহার সবই এনেছেন বাসন্তিকা গানে। তার গান মানেই বাংলাদেশের প্রকৃতির পূর্ণ বর্ণনা। বসন্তের ফুলে, কচিপাতার সমাহারে ছুটে চলা শিশুদের প্রাণের উচ্ছ্বাস। শ্রেষ্ঠ ঋতুর রূপেরঘটার কথা শুনি জাতীয় কবির গানে।