তোমাদের জন্য

শিশিরভেজা শীতের সকাল

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শেখ একেএম জাকারিয়া
ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ ঋতু দুমাস পর পর বদল হয়। ছয় ঋতু ক্রমান্বয়ে ঘুরতে থাকে প্রকৃতির বুকে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় শীত আসে বাংলাদেশের সবুজ ছায়াঘন সুনির্মল প্রকৃতিতে। হেমন্তের শেষদিকে ফসল ভরা সবুজ, হলুদ মাঠ যে সময়ে রিক্ত হয়ে ওঠে, সেই সময়ে ঘন কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকে শীত আসে এ দেশের মাঠেঘাটে, অলিতে-গলিতে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে বাড়তে থাকে শীতের প্রাবল্য। দক্ষিণের বিপরীত থেকে আসা মৃদু পবন এসময় অতু্যগ্র ঠান্ডা নিয়ে আমাদের মধ্যে হাজির হয়। প্রকৃতি এসময় তার দেহবসন খুলে নিজেকে মেলে ধরে খসখসে বিরক্তির মুখে। প্রকৃতিতে সৃজন হয় নতুন এক অধ্যায়ের, নতুন এক সৌন্দর্যের। শীতের সকালের এ সৌন্দর্যে প্রাণিজগৎ বিমোহিত হয়। প্রতিটি শীতের সকাল আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয় কুজ্ঝটিকায় ঘেরা উপমাহীন সৌন্দর্য নিয়ে। পুবের সূর্য আগুনের শিখা পুরোপুরি ফুটে ওঠার আগেই পশুপাখির হৃদয়ে সূর্য আসার গোপন সংবাদ সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের প্রাবল্য থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য সূর্যকে অভ্যর্থনা জানাতে গায়ের প্রতিটি গোয়াল ঘরে, বন-বাদাড়ে পশু-পাখির কণ্ঠে ভেসে ওঠে সূর্য আসার আহ্বানগীতি। এ সময়ে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তীব্র শীতের কামড় অগ্রাহ্য করে ছুটে চলেন মসজিদে। এর কিছুক্ষণ পরেই কুজ্ঝটিকা ভেদ করে ফুটে ওঠে আলোকরশ্মি। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের সবুজমাঠে গবাদিপশুর ডাক আর রাখালের পদচারণা শুরু হয়। কৃষকরা লাঙল-জোয়াল কাঁধে করে গরু-মহিষ নিয়ে চাষবাসের জন্য মাঠে যায়। তাদের গায়ে থাকে গতানুগতিক শীতবস্ত্র। অনেকের হয়তো তা-ও নেই। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আপন কাজে মাঠে চলে। আমাদের দেশে শীত সকালের দৃশ্য একটু ভিন্ন আমেজের। পুরো সকাল এসময় কুহেলিকায় ঢাকা থাকে। মাঠের পর মাঠ বনের পর বন, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর অর্থাৎ পুরো প্রকৃতিকে কে যেন সাদা কাপড় পরিয়ে ঢেকে রাখে। ঘড়ির দিকে না তাকালে বোঝার কোনো উপায় নেই অনেক বেলা হয়েছে। প্রকৃতির এমন রূপ দেখলে মনে হয় যেন এই মাত্র সকাল হয়েছে। এসময় পুরো প্রকৃতি থাকে শিশিরস্নাত। ঘরের বাইরে বের হলে অনুভব করা যায় হাড়কাঁপানো কনকনে শীতের প্রভাব কতটুকু। লেপ-কাঁথা ছেড়ে উঠতে কিছুতেই মন সায় দেয় না। শিশু-কিশোররা সাতপ্রভাতে সূর্যের মিঠামুখ দেখার জন্য বারবার জানালায় উঁকি দেয়। তা ছাড়া এমন দিনে ছোট-বড় সবাই বাড়ির আঙিনায়, শহর-গ্রামে পাড়ার ভেতরে খোলা জায়গায়, সড়কে দলবেঁধে গালগল্পে মেতে ওঠে। কোথাও কোথাও আগুন পোহাবার মনোমুগ্ধকর দৃশ্যও চোখে পড়ে। শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ পেঁয়াজ-রসুনের সবুজক্ষেত, সরিষা ফুলের হলুদ মাঠ, মাচায় ঝুলে থাকা শিম- লাউয়ের বাহারি ফুল। সকালের সূর্যোলোক যেন তার নিপুণ হাতে প্রতিটি উদ্ভিদ ও পুষ্পকে নবরূপে সাজিয়ে তোলে। শীতের সকালে গ্রামের প্রকৃতি এক কথায় অনির্বাচনীয়। এসময় গ্রামের পরিশ্রমী মানুষের একটু আরাম করার জো নেই। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের জন্য শীতের সকাল খুবই কষ্টকর। শীত নিবৃত্তির মতো দরকারি কাপড়-চোপড় অনেকেরই থাকে না। শীতের তীব্রতা অগ্রাহ্য করে খুব সকালে তাদের মাঠঘাটে কাজ করতে যেতে হয়। কিষাণ বধূরাও তখন ধান সিদ্ধ, সিদ্ধধান শুকানো, ধান ভানা, রান্নাবান্না ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া শীতসকালে গ্রাম-গঞ্জে ফেরিওয়ালাদের দেখা যায়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মোয়া-মুড়কি, নানা ধরনের মিঠাই-মিষ্টি, খেজুরের রস ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে। এসময় সকালের সোনালি রোদ হীরক দু্যতি ছড়িয়ে দেয় গ্রাম-গঞ্জের মাঠেঘাটে ও হাটে। সবুজ ঘাসের ওপরে জমা সূর্যালোকিত শিশিরবিন্দু চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এ দৃশ্য যথার্থই মনোরমা। শীতের সকালে যখন কথা বলার সময় মুখ থেকে হালকা গরম সাদা ধোঁয়ার মতো বের হয়, নদী থেকে জলীয় বাষ্প যখন কুয়াশার সঙ্গে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তখন প্রকৃতিতে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। অন্যদিকে শীতের সকালে শহরের অবস্থা ভিন্নতর। এ সময়ে গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠঘাট যে সৌন্দর্য মহিমায় সেজে ওঠে, শহরের ইট-পাথর ঘেরা কৃত্রিম পরিবেশে তার আভাস তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। শীতের সকালের অনেক উপভোগ্য জিনিস রয়েছে। তারমধ্যে আলোচাল ভাজা ও মুড়ি খুব আরামদায়ক খাবার। এসময় গুড়সহ আলোচাল ভাজা, মুড়ি খেতে খেতে রোদকে উপভোগ করার দৃশ্য পলিস্ন বাংলায় এখনো দেখা যায়। ঘরে ঘরে সে সময়ে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে। শীতে গরম গরম ভাপা পিঠা খেতে যে মজা পাওয়া যায়, যা অল্পকথায় লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এসময় গাছ থেকে পাড়া তাজা খেজুরের নির্যাস পান করা খুবই তৃপ্তিদায়ক। এ খেজুরের নির্যাস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস খাওয়ার মধ্যেও রয়েছে এক নির্মল আনন্দ। শীতঋতুর এই বৈচিত্র্যময় আমেজ মানুষের মনকে যথার্থই আলোড়িত করে।