শিশুতোষ গল্প

দিনুর জাদুরকাঠি

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মনিরা মিতা
পঁ্যাক পঁ্যাক হাঁসের শব্দে ঘুম ভাঙে দিনুর। চোখ কচলে পিনপিন করে তাকায় দিনু। তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মাথাটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে থাকে দিলু। পেছনের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করে সে। চোখের সামনে কাঁচের মতো এক এক করে ভেসে ওঠে সব ঘটনা। গতরাতে তার নতুন মা খুব মেরেছিল তাকে। খেতেও দেয়নি। দিনু না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠেই নতুন মা গরুর দড়িটা হাতে ধরিয়ে দেয় সঙ্গে একপাল হাঁস। সারাদিন গরু আর হাঁস চরিয়ে সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরতে হবে ওকে। দুপুরের এই কড়া রোদে খিদে পেটে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল দিনু। গত বছর কী এক জ্বরে মরে গিয়েছিল দিনুর মা। খুব কেঁদেছিল সে। মা মারা যাওয়ার পর দিনুর বাবা নতুন মা নিয়ে আসে। কিন্তু নতুন মা দিনুকে একদম দেখতে পারে না। ঠিকমতো খেতে দেয় না ওকে। খুব কষ্ট দেয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে দিনু। কিন্তু নতুন মা তাকে স্কুলে যেতে দেয় না। দিনুর জীবন থেকে যেন সব খুশি হারিয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে গরুর কথা মনে পড়ে দিনুর। সেকি! গরুটা দেখছে না কেন? দৌড়ে যায় সে। গরু দড়ি ছিঁড়ে অন্যের জমির ফসল খাচ্ছে। এটা দেখেই ছোট দিনুর প্রাণটা উড়ে গেল। জমির মালিক বাড়ি গিয়ে নালিশ করলে নতুন মা ওকে খুব মারবে। খেতে দেবে না। অনেক কষ্টে দিনু গরুটা টেনে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল। ওদিকে হাঁসগুলো পানি পিপাসায় পঁ্যাক পঁ্যাক করে ডাকছে। সামনে পুকুর থেকে এক হাঁড়ি পানি তুলে হাঁসগুলোকে খেতে দিল দিনু। এসব করে ক্ষুধার্থ দিনু খুব ক্লান্ত হয়ে গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। দিনুর দুই চোখ থেকে ঝরছে কষ্টের অশ্রম্ন। ক্লান্ত দিনুর চোখে আবার ঘুম নেমে এলো। হঠাৎ দিনু একা মেয়েকে দেখে। ওমা! কি সুন্দর মেয়ে! গায়ে নীল জামা। হাতে সোনালি লাঠি। একি! পেছনে ছুটি পাখনা মেয়েটির। মেয়েটি দিনুকে ডাক দিল। দিনু অবাক চোখে চেয়ে থাকল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি দিনুকে বলল 'এই তুমি সব সময় এভাবে কাঁদো কেন?' দিনু প্রশ্ন করল তার আগে বলো তুমি কে? আমি নীল পরী। আমি প্রতিদিন এখান দিয়ে যাই আর তোমাকে কাঁদতে দেখি। তুমি কেন কান্না করো? পরী শুনে ভীষণ অবাক হয়। আবার তার খুব ভালোও লাগে। এত কাছ থেকে আকাশের পরী দেখছে সে। দিনু আস্তে আস্তে নীল পরীকে তার সব কষ্টের কথা খুলে বলে। পরীকে শোনায় তার নতুন মায়ের অত্যাচারের কাহিনী। সেই সঙ্গে শোনায় তার স্বপ্নের কথা। বড় হয়ে সে সমাজের একজন বিখ্যাত মানুষ হতে চায়। তাই দিনু লেখাপড়া করতে চায়। কারণ লেখাপড়া ছাড়া জীবনে কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। নীল পরী খুব মন দিয়ে দিনুর কথা শোনে। ওর স্বপ্নের কথা শুনে খুব খুশি হয়। নীল পরী দিনুকে বলে তুমি নিশ্চয় তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। তুমি তোমার স্বপ্নের চেয়েও বড় হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব তোমার স্বপ্ন পূরণে। নীল পরী তার হাতের সোনালি লাঠিটায় একটি মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিল। অমনি একটি রুপার কাঠি এসে হাজির হয়। নীল পরী দিনুকে রুপার কাঠিটি দেয়। দিনু বড় বড় চোখে কাঠি দেখতে থাকে। নীল পরী বলে এটি জাদুর কাঠি। তুমি যা চাইবে কাঠি তোমাকে তাই এনে দেবে। শুনে মহা খুশি হয় দিনু। নীল পরি বলে তবে একটা শর্ত আছে। কাঠিটি তখনই তোমার কথা শুনবে যখন তুমি কোনো না কোনো ভালো কাজ করবে। পড়ন্ত বিকেলে গাছের ডালে পাখিগুলো কিচিরমিচির করে ডাকছে। সে ডাকে ঘুম ভাঙে দিনুর। ঘুম ভাঙলেও স্বপ্নের কথাগুলো মনের ভেতর ঘুরপাক খায় দিনুর। ইস, সত্যি যদি এমন হতো! হঠাৎ দিনুর চোখ যায় তার জামার পকেটে। ওমা! সত্যিই সেই জাদুর কাঠি তার জামার পকেটে। কাঠিটি দেখে খুশিতে নাচতে থাকে দিনু। ওর মনে যেন আনন্দ আর ধরে না। চট করে সে জাদুর কাঠিকে তার জন্য ভালো ভালো খাবার আনতে বলে। কিন্তু কিছুই তো এলো না। কয়েকবার চেষ্টা করেও কিছু এলো না। মন খারাপ হয়ে গেল দিনুর। এমন হয় ওর মনে হলো নীল পরী বলেছিল জাদুর কাঠি তখনই কাজ করবে যখন সে একটা করে ভালো কাজ করবে। কিন্তু কি ভালো কাজ করবে দিনু? এমন সময় দিনু দেখতে পেল একটা ছাগলের পায়ে দড়িতে পঁ্যাচ লেগেছে। ছাগলটা ভঁ্যা ভঁ্যা করে ডাকছে। দিনু দৌড়ে গিয়ে ছাগলটার পা থেকে দড়িটা খুলে দিল। অমনি ছাগলটি তিড়িংবিড়িং করে নাচতে শুরু করল। এটা দেখে দিনুর মনটাও ভালো হয়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে দিনু গাছের নিচে ফিরে এলো। লাঠিটা হাতে নিয়ে সে বলল এখন খাবার পেলে কতই না ভালো হতো! অমনি নানা স্বাদের খাবার এসে হাজির হয়ে গেল। দিনু বুঝতে পারল ছাগলটাকে মুক্ত করে দেওয়াই ছিল একটা ভালো কাজ। এজন্য জাদুর লাঠি কাজ করেছে। অনেক দিন পর দিনু পেট ভরে ভালো ভালো খাবার খায়। দিনু খুব খুশি হয়। আর মনে মনে বলে এখন থেকে রোজ একটা করে ভালো কাজ করতে হবে। এরপর থেকে দিনু প্রতিদিন ভালো কাজ করতে থাকল। এই যেমন বৃদ্ধ কাউকে দেখলে তার কাজে সাহায্য করে। কখনো গাছে পানি দেয়। কখনো বিড়াল ছানাটাকে খাবার দেয়। কখনো রাস্তায় পড়ে থাকা ভারী বস্তুগুলো তুলে ফেলে। কখনো কলার খোসা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে। এভাবে প্রতিদিন দিনু ভালো কাজ করতে থাকে। আর প্রতিদিন জাদুর কাঠি দিনুর ইচ্ছাগুলো পূরণ করে। আজ দিনুর জীবনে কোনো কষ্ট নেই। ভালো কাজ করে তার মনটা খুব ভালো থাকে। ভালো কাজ আর জাদুর কাঠির পরশে তার জীবনটা রঙিন হয়ে ওঠে।