তোমাদের জন্য

শিশুর মানসিক বিকাশে মাতৃভাষা

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ওবায়দুল মুন্সী
'সবশিশুদের মায়ের বুলি/ মন-মগজে জাগায় আশা/ মাতৃভাষা তাদের কাছে/ সবার সেরা দারুণ খাসা'। মায়ের মুখের বুলিই হচ্ছে শিশুদের মাতৃভাষা। এটা হয়তো সাধারণ কথা। অন্যভাবে বলতে গেলে, যে দেশে শিশু জন্মগ্রহণ করে, যে দেশের ভাষা পরিমন্ডলে সে বড় হয়ে ওঠে সেই দেশের ভাষাই তার মাতৃভাষা। জন্ম থেকেই শিশু সেটা লাভ করে এবং সহজাতভাবে পালন করে। তারপর সে যত বড় হতে থাকে ততই এই ভাষার কাছে তার পরিচয় গভীর হয়ে ওঠে। ভাষাগত এই যে পরিবেশের মধ্যে শিশুর জন্ম এবং এর মাধ্যমে সে দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে বিকশিত হয়। আর যে নিজের ভাষায় ভাব প্রকাশ করতে পারে না! তার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সে তখন পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। শিশুমনে ভাষাজ্ঞান বিশেষ করে মাতৃভাষার শিক্ষণ তার ভিতরে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। বিদেশি ভাষার আশ্রয়ে শিশুর মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'সেজদা বলতেন, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি; তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।' তাই মাতৃভাষার শিক্ষাকে শিশুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম মাধ্যম হতে হবে তার মাতৃভাষা। কিন্তু আজকাল দেখা যায়, বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে মাতৃভাষার চর্চা খুবই নাজুক। এটা শিশুদের ক্ষেত্রে কোনোমতে কাম্য নয়। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, মানসিকভাবে যদি শিশুর জীবন পথের বিকাশ ঘটাতে হয় তাহলে যত্নসহকারে তাকে মাতৃভাষার যথাযথ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। শিশুর অস্তিত্বও এই মাতৃভাষা। মায়ের কোলে শিশু জন্মগ্রহণ করে, জন্মেই সে মায়ের কথা শোনে। মায়ের মুখের সেই কথাগুলোই হলো একটি শিশুর মাতৃভাষা। শিশুর খাওয়া, ঘুম, আরাম সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার মাতৃভাষা এবং মাতৃভাষার সোনার কাঠির পরশ তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। তাহলে বলতে পারি মাতৃভাষার রসধারায় সিঞ্চিত হয়ে শিশুর সবরকম মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে এবং ক্রমে তা পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে। মানসিক বিকাশ বলতে বুদ্ধিমত্তা বা মেধা ছাড়াও শিশুর মানসিক গুণাবলি সাধিত হয়। মেধা বা বুদ্ধি শিশুর একটা সহজাত প্রবৃত্তি। বীজের মধ্যে যেমন বৃক্ষ সুপ্ত থাকে তেমনি মানবশিশুর মধ্যে মানবিক গুণগুলোও অপ্রকাশিত রয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর সুপ্ত ক্ষমতার জাগরণ ঘটতে থাকে। শিশুর চলাফেরা আচার-আচরণে সেই সুপ্ত ক্ষমতার আভাস মেলে। তার স্মরণশক্তি উদ্ভাবন ক্ষমতাও মানসিক গুণের পরিচয় বহন করে আর এসব গুণাবলির জাগরণ ঘটে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে। ভাষা পরিবাহিত হয়ে সেই ভাব আমাদের শ্রবণে প্রবেশ করে, ভাষার সাহায্যে আমরা সব চাহিদা ও অনুভূতি প্রকাশ করি। এই যে গ্রহণ ও প্রকাশ দিনরাত চলছে সেটা সম্ভব হচ্ছে এই ভাষার কল্যাণে। শিশুর বেলাতেও মাতৃভাষার স্বরতরঙ্গ তার মনে ও কানে প্রবেশ করে মনোজগতের সৃষ্টি করে। জানা কথা শোনা শব্দ ও বাক্যের নেপথ্যে এই ভাবকে গ্রহণ করতে শিশুর কোনো অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয় তখন, যখন অন্যভাষা, অজানা শব্দ, এবং দুর্বোধ্য বাক্যগুলো পথ রোধ করে দাঁড়ায়। এভাবেই মাতৃভাষার কল্যাণময় পরশে শিশুর মানসিক বৃত্তিগুলো জাগ্রত ও বর্ধিত হয়। জীবনধারণের জন্য শিশুর যা কিছু প্রয়োজন তা মাতৃভাষার সাহায্যে প্রকাশ করে। প্রথমদিকে যদিও তার ভাষা থাকে শিশুসুলভ ও অস্ফুট বা ভুলে ভরা, কাব্যিক ভাষায়- 'ছিছিরে তিতি কয়, পানিকে কয় মানি অবুঝ এ শিশুবুলি সবাই তা জানি'। তবুও শিশুর সেই ভাষা তাকে সে ব্যাপারে সহায়তা করে এবং এ ভাষাতেই সে তৃপ্ত হয়। বড় হওয়ার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের পথটিও প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হতে থাকে। আসলে, শিশু পৃথিবীতে নবাগত। পরিবেশ সম্পর্কে তার প্রশ্নের শেষ নেই! মা-বাবা, ভাইবোনকে সে সারাক্ষণ প্রশ্ন করে এই মাতৃভাষায়। আবার এই মাতৃভাষার মাধ্যমে সেও তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি ও কল্পনাশক্তিকে পরিতৃপ্ত করে। যা শিশুর মানসিক বিকাশের সহায়ক হয়। শিশু যখন পড়তে থাকে বা পড়তে শেখে তখন মাতৃভাষার সঙ্গে তার এক নতুন পরিচয় ঘটে। শিশু তখন বুঝতে পারে যে, পড়া হলো ছাপানো কথা, সে আরও বুঝতে সক্ষম হয়, বর্ণ, শব্দ, বাক্য তার পারিভাষিক অর্থ। শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবনে 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' শব্দগুলো মাতৃভাষায় তার কাছে অপূর্ব এক অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। আর এই অভিজ্ঞতাও শিশুর মানসিক বিকাশে এক অমূল্য সম্পদ, যার কোনো সজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন খেলার মাধ্যমেও মাতৃভাষার চর্চা করা যায় আর এই খেলাধুলা শিশুর অস্তিত্বেরই অংশ। খেলতে খেলতে শিশু বড় হয়, সে মানুষ হয়ে ওঠে। আর এই খেলাধুলার ভাষাগুলোই শিশুর মাতৃভাষা। তাই শিশুর জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুর খেলাধুলার এই অবদান প্রভাব ফেলে তার মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে। তেমনি শিশুতোষ বিভিন্ন ছড়া, কবিতাও শিশুর জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বীরপুরুষ' কবিতায় শিশুমনের সাহসিকতা ও বীরত্বের রূপ দিয়েছেন। আর এই মুক্ত কল্পনার ও অনুভূতির প্রকাশ সম্ভব হয়েছে এই মাতৃভাষার মাধ্যমে। শিশুমনে মানসিক বিকাশের বাতিঘর হচ্ছে মাতৃভাষা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের, থাকবো নাকো বদ্ধঘরে/ দেখবো এবার জগৎটারে; কবি গোলাম মোস্তফার, লক্ষ আশা অন্তরে/ঘুমিয়ে আছে মন্তরে; কবি সুফিয়া কামালের, তুলি দুই হাত/ করি মুনাজাত; পলস্নী কবি জসিমউদ্‌দীনের, মামার বাড়ি ইত্যাদি অবিনশ্বর কবিতার বাণী মাতৃভাষার হীরার খনি। এসব কবিতার ছবি ও কথামালা মাতৃভাষার উজ্জ্বল আলোতে শিশুর মনোজগতে যে ফুল ফোটে, ফল ফলে তারই কালজয়ী ফসল। মানবশিশু একটি বিশেষ ভাষাময় পরিবেশে তার ভাষা শেখে এবং অর্জন করে মাতৃভাষার দক্ষতা। এর জন্য তাকে বিদ্যালয়ে ভাষার ব্যাকরণ শেখানোর প্রয়োজন হয় না। তাই মায়ের কোলে, বাবার স্নেহে অধ্যাবসায় দ্বারা হয়তো একাধিক ভাষা তাকে শেখানো সম্ভব কিন্তু মাতৃভাষার গৌরব ও আবেগ একটুও কমে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রতিটি শিশু তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। উদারতা, দয়া, সহনশীলতা, এসব মানবিক গুণাবলি মাতৃভাষার দ্বারাই শিশুমনে প্রকাশিত হয়। মাতৃভাষার জন্য এ দেশের সোনার ছেলেরা জীবন দিয়েছে। ফেব্রম্নারির একুশ তারিখ অর্থাৎ বাংলা আট ফাল্গুন সেই মহান আত্মত্যাগের স্মৃতিকে বহন করে চলছে। এজন্য সমাজ তথা শিশুদের মানসিক বিকাশে মাতৃভাষার গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমার কাব্যিক ভাষায়- শিশুর চোখে ভাষার মাসে / বর্ণমালার ছবি ভাসে/ বর্ণ ছবি আঁকে বুকে তাই/ এমন ছবি আর কোথাও নাই!