বোকা চাষি ও ইঁদুর

প্রকাশ | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

রকিয়া জান্নাত রুমা
এক যে ছিল চাষি। চাষির জীবনে খুব দুঃখ, কিন্তু সৎ ও পরিশ্রমী। বাড়ি থেকে দূরে নয় ধানের ক্ষেত। উঠোনে বের হলে প্রদর্শন করা যায়। অন্যের জমি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জমিতে ধানের মোহনীয় দৃশ্য দেখে চাষি খুশি হলেও দুঃখ দুঃখভাব নিয়ে সারাক্ষণ চলে। ধান পেঁকেছে। ধান কেটে প্রতিবারের মতো বাড়ি নিতে হবে। কিন্তু দুই বছর থেকে একই অস্থিরতায় ভুগছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হলো না। ধান কেটে মাঠে রাখল। চাষি বাড়ি চলে এলো। বউকে ডেকে বলল, ধানের ফলন ঢের হয়েছে। গতবারের চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। একটি ঘর, ধান কীভাবে রাখবে। ভেবে কূল পায় না। ধান মাড়া হলো। ঘরটি বেশ বড় হওয়ায় ধানগুলো সব রাখার ব্যবস্থা হয়ে যায়। খুব আনন্দের সঙ্গে চাষির দিনগুলো কাটছে। বউ চরম খুশি। কিন্তু চাষির মনের ভিতরে কেমন যেন অনুভূত হয়। ভয় ভয় কাজ করে। ধানগুলো তার প্রধান সম্পদ। কোনোরূপ ক্ষতি হোক তা তিনি মেনে নিতে পারেন না। অসুস্থ মা সঙ্গে নিয়ে থাকেন। চাষির বউটা অমায়িক। দুজনে মায়ের সেবা করেন। ধানগুলো সাদা বস্তায় করে ঘরের এক পাশে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। চাষি নিয়মিত ধানের তদবির করে, অন্তত ধানগুলো ভাপা পর্যন্ত। ধান থেকে কিছু চাল বের করবে, কিছু বীজ রাখবে, আর কিছু বিক্রি করে সংসার ও মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। গভীর রাতে চাষির ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ দেখে একটি গেছো ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। মুহূর্তে দৃষ্টি ফেরায় ধানের দিকে। খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। অবশেষে যা ধ্যান ছিল তাই হলো। কয়েকটা বস্তার তলা কুটি কুটি করা। বিশাল সুড়ঙ্গ দেখে আঁতকে উঠেছে। হায় হায় এবারও ইঁদুরের হাত থেকে নিস্তার মিলল না। রাতটি কোনো রকম পার করে। ভোরে একটা ব্যবস্থা করে। মাটির উপর সব সুড়ঙ্গপথ। মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়। এবার আগের থেকে একটু ভালো করে প্রটেকশন দিয়ে সুন্দর করে পলিথিন ও কাঠ দিয়ে ধানগুলো রাখে। কিন্তু চাষি তো! মানুষ যতই ভালো ধারণা করুক ব্যতিক্রম হবেই। যা এ-র থেকেও ভালো ব্যবস্থা গ্রহণের যোগ্যতার অভাব আছে। ইঁদুরের কাছে তেমন কিছুই না। ইঁদুরগুলো বেশ চালাক। ধলা ইঁদুর কালো ইঁদুরকে ডেকে বলল, ভাই- চাষি বড়ই বোকা। পলিথিন ও কাঠ দিয়েছে, আমরা হতাশ নই। আমাদের খাবার আমরা সংগ্রহ করবই যেভাবেই হোক। অবশ্য দুই-তিনদিন উপোষ থাকতে হবে। ও ব্যাপার না, আমরা এতে অভ্যস্ত। কিন্তু ভাই আমাদের বাচ্চা-মনা ও টিনা এদের তো বোঝাতে পারব না। কিছু একটা করতে হবে নয়তো মরে যেতে পারে। সাজানো স্বপ্ন সব ভেঙে চুরমার হবে। পাগল হয়ে যাবো আমি। ধলা ইঁদুর বলল, আমি এই শোক সইতে পারব না। কিছু দিন আগে পিনাকে হারিয়েছি। ওই বদরুল ফাঁদে ফেলে মেশিন দিয়ে ধরে। খুব নির্মমভাবে নির্যাতন করে। তাকে মেরেছে। আমি আর বর্ণনা দিতে পারছি না। হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছে। আহা, পিনপতন নীরবতা নিয়ে কালো ইঁদুর শ্রবণ করছিল। কালো ইঁদুর ধলা ইঁদুরকে সান্ত্বনা দিল। দুজনে রাজার কাছে গেল। দুদিনের জন্য খাবার নিয়ে এলো। ঠিক দুদিন পর কাঠ কেটে খাবার সংগ্রহ করে। আর কোনো টেনশন নেই। দুজনের মধ্যে একটি ইঁদুর কেমন যেন আবেগপ্রবণ হয়ে বলে উঠল। \হএতে চাষি ভীষণ কষ্ট পাবে। কালো ইঁদুর বলল- আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। মাঠে কোনো ফসল নেই। বেঁচে থাকার জন্য চাষির ক্ষতি করতেই হবে। তাই এভাবে। হুম.... ধলা ইঁদুর বলল চাষি তো খুব গরিব, সে খুব পরিশ্রমী। কষ্ট করে ফসল মাঠ থেকে বাড়িতে এনেছে। সবাই দেখেছি। আমরা তার কষ্টের ফসল কেন নষ্ট করব? কালো ইঁদুর বলল- এত কিছু ভাবলে তুই চলে যা আমি একাই থাকব। অন্য কোথাও যাবি যা; সব জায়গায় মরণফাঁদ পাতা আছে। কোথায় যাবি? কেন আমরা যদি প্রকৃতি থেকে ধানের মৌসুমে কিছু সংগ্রহ করে রেখে দিতাম, তাহলে পরের ক্ষতি না করলেও হতো। কালো ইঁদুর বলল, হুম তা ঠিক। ধলা ইঁদুর বলল, হঁ্যা চলে যাবো। আর অন্যের ক্ষতি করব না। ধলা ইঁদুর তার কাছ থেকে বিদায় নিল। কালো ইঁদুর রয়ে গেল। সঙ্গে আরও কিছু ইঁদুর। তারা পরিকল্পনা করল প্রতিদিন খাবার সংগ্রহ করবে আর দিন চালাবে। চার সদস্য বিশিষ্ট গোপন বৈঠক করে, কীভাবে কে কখন কি করবে। সবাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাষির সাদা বস্তাগুলো কুটিকুটি করে কেটে ধান বের করার প্রস্তুতি নিল। কথা অনুযায়ী কাজ করল। চাষি আবার খেয়াল করে। এবার দেখে বেশ কয়টা বস্তায় ফুটো করেছে। ধানগুলোর পাতান বের হচ্ছে। চাষি কি করবে খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ধান নিয়ে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। চাষি তার বন্ধুকে বিষয়টা খুলে বলে। সে একটা পরামর্শ দেয়, বিড়াল পোষার। বিড়াল আবার কি করতে পারবে? চাষি অহংকার করল। মানুষ হয়েই তো কিছু করতে পারছি না। ওরে বোকা এটা বিড়ালের কাজ। মানুষের কাজ নয়। মানুষ চেষ্টা করলেও ইঁদুর তাড়াতে পারবে না। যতই প্রস্তুতি গ্রহণ করুক। ইঁদুর বাসা বাঁধবেই। বন্ধুর এমন পরামর্শ সে কিছুদিন পর ভেবে-চিন্তে গ্রহণ করল। একটি বিড়াল ক্রয় করে বাসায় নিয়ে এলো, বিড়ালটি রীতিমতো পোষ মেনে যায়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই লক্ষ্য করল ধান যেভাবে রেখেছে ঠিক সেভাবে রয়েছে। বস্তাগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে, ইঁদুরগুলো নেই। বাসায় নেই তো নেই; আশপাশেও দেখতে পেল না। বিড়ালটি বাড়িতে আসার পর অনেক উপকার হয়েছে। ইঁদুরগুলো সবই পালিয়েছে। দুর হলো চাষির দুঃখ। তৃপ্তির সঙ্গে এখন নিঃশ্বাস নেয়। বিড়ালের প্রতি ভালো একটা মহব্বত তৈরি হলো। চাষি মনে মনে পাঠ করছে বন্ধুর ভালো পরামর্শটি যদি প্রথমে গ্রহণ করতাম, তাহলে ধানগুলোর এত ক্ষতি হতো না। হায় আফসোস! কেন প্রথমেই বন্ধুর পরামর্শ প্রাধান্য দিলাম না।