মুক্তিযুদ্ধের গল্প

গল্প শোনার গল্প

প্রকাশ | ১৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সোহেল বীর
আ ফিল স্যার নবম ও দশম শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণির ক্লাস নেন না। স্যারের গল্প শুনি স্কুলের বড় ভাইদের কাছে। স্যারের চমৎকার বাচনভঙ্গি এবং কথায় শব্দের সাবলীল ব্যবহার তা স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি আর উপস্থাপনা শুনেই বুঝেছিলাম। দরাজ কণ্ঠের এই মানুষকে আমার অনেক ভালো লাগে। খুব ইচ্ছে হতো স্যারের ক্লাস করার। আজ সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো। টানা দুই বছর স্যারের ক্লাস করতে পারব। স্যার বাংলা প্রথমপত্র ও দ্বিতীয়পত্র ক্লাস নেবেন। ক্লাস রুটিনে তা-ই উলেস্নখ আছে। প্রথমদিন ক্লাসে এসে স্যার সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। বললেন, ক্লাসের প্রথম দিন পরিচিতি পর্ব। আর কোনো ক্লাস নিলেন না। একদিন ক্লাস শেষে গল্প শোনাতে চাইলেন। বললেন, 'তোমরা বলো, কী গল্প শুনতে চাও?' আমি সাহস করে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, 'স্যার যুদ্ধের গল্প শুনতে চাই।' আমার কথা শুনে স্যার কিছুটা অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন, 'তুমি কীভাবে জানো, আমি যুদ্ধ করেছি?' বললাম, 'মিজান স্যারের কাছে শুনেছি। মিজান স্যার আমাদের সপ্তম শ্রেণির ক্লাসে একদিন বলেছিলেন।' স্যার এবার মৃদু হেসে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। এরপর যুদ্ধের গল্প বলা শুরু করলেন- 'কলেজে তখনো ভর্তি হইনি। এমন সময় বুঝতে পারলাম দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছে পাশের বাড়ির রবজেল ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই ভারতে গেছেন প্রশিক্ষণ নিতে। দলে দলে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের দেশে আসা শুরু করেছে। নিরীহ মানুষকে খুন করছে। মা-বোনদের সম্ভ্রম কেড়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের একজন সচেতন যুবক হিসেবে কিছু একটা করতে হবে। দুদিন ধরে ভাবলাম। নিজের মনের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলতে লাগল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম- যুদ্ধে যাব। রবজেল ভাইয়ের সঙ্গে চলে গেলাম বিহারে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে এলাম। সেসময় বাড়ির কাউকে কিছু বলিনি। একমাত্র ছোটবোনকে বলেছিলাম। যাওয়ার সময় ছোটবোনের একচোখে অশ্রম্ন আর অন্যচোখে যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা দেখেছিলাম। বাড়ির অন্য কাউকে বলতে নিষেধ করেছিলাম। কেউ না জানুক সেটাই চেয়েছিলাম। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। একদিন বাড়িতে চিঠি লিখলাম। এক সপ্তাহ পর চিঠির উত্তর এলো। জাহিদরা এলাকার খবরাখবর নিতে বাড়ি গিয়েছিল। তার কাছেই চিঠিটা দিয়েছিল। গ্রামের অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। রবজেল ভাইয়ের বোনটাকে ধরে নিয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে।'- গল্প বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন আফিল স্যার। চশমাটা খুলে বাঁ হাতের দুই আঙুল দিয়ে দু'চোখের কোণা মুছলেন। পিনপতন নীরবতা। সবাই তন্ময় হয়ে যুদ্ধের গল্প শুনছি। স্যার আবার গল্প বলা শুরু করলেন, 'রাজাকারদের মাধ্যমে আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে চলে গেছে। আমরা সবাই নিজেদের নাম পাল্টে ফেলেছি। প্রায় প্রতিদিন একেকটা সফল অভিযান সম্পন্ন করি। এর মধ্যে একদিন খবর এলো, রবজেল ভাইয়ের বোনকে ওরা মেরে ফেলেছে! সংবাদটা শুনে আমরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। বোন হারানোর শোক শক্তিতে পরিণত হলো। এলএমজি, স্টেনগান যার কাছে যা ছিল তা নিয়ে ওই রাতেই ঝাউদিয়া ক্যাম্পে আক্রমণ করলাম। ২২ জন পাকিস্তানি আর্মি ও তিনজন রাজাকারকে শেষ করে দিলাম। ঝাউদিয়াসহ আশপাশের এলাকামুক্ত ঘোষণা করে প্রথম পতাকা তুললেন তারিক ভাই। উদ্ধার করা হলো অনেক নিরীহ মানুষকে। - হঠাৎ স্কুল ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল। কখন যে শেষ ক্লাসের সময় ফুরিয়ে গেছে কেউ টের পাইনি। গল্প বলতে বলতে আফিল স্যারও যেন সেই যুদ্ধদিনে ফিরে গেছেন। স্যারও গল্পটা শেষ করতে চাইছেন। কিন্তু স্কুলের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হলো না। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। পরদিন। সকাল থেকে ঝড়-বৃষ্টি। ভাবলাম স্কুলে আজ আর কেউ আসবে না হয়তো। ঝড়-বৃষ্টি কিছুটা থামল। মাথার মধ্যে আফিল স্যারের গল্প শোনার তীব্র আগ্রহ। ক্লাসে কেউ কি আসবে আজ?- মনে মনে ভাবলাম। আফিল স্যারও যদি আজ না আসেন! শুধু শুধু কষ্ট করে স্কুলে যাওয়া হবে না তো! সবকিছু ভাবা বাদ দিয়ে ছাতা আর স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ক্লাসে সবাই উপস্থিত! জানতে পারলাম আফিল স্যার গল্প বলা শুরু করেননি। আমার জন্যই শুরু করেননি- পরে জানলাম। দেরিতে যাওয়ায় সবার পেছনে বসতে হলো। স্যার গল্প বলা শুরু করলেন- 'যুদ্ধের শেষ দিকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা মুক্ত হচ্ছে। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের আশার আলো জ্বলে উঠছে। আমরা কুষ্টিয়া শহর থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তারিক ভাইয়ের বাড়ি পোড়াদহ। টিমের সবচেয়ে হাসি-খুশি আর প্রাণোচ্ছল মানুষ তারিক ভাই। একবার কঠিন বিপদের মধ্যেও তারিক ভাইয়ের সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্য হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। দুর্বার সাহসী এই মানুষটা ট্রেনিং ক্যাম্পেও সবাইকে প্রাণিত করেছে সবসময়। দেড়মাস আগে শেষবারের মতো তারিক ভাই তার মায়ের একটা চিঠি পেয়েছিলেন। সেখানে খালাম্মা লিখেছিলেন, তাকে নিয়ে যেন তারিক ভাই কোনো চিন্তা না করেন। তিনি ভালো আছেন। লাল-সবুজের পতাকা হাতে বিজয়ীর বেশে সবাই যেন তার সামনে হাজির হই- এই স্বপ্নই তিনি দেখেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জানতে পারছিলাম প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা মুক্ত হচ্ছে। সংবাদগুলো শুনে সবাই আশান্বিত হচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম বিজয় খুব সন্নিকটে।'- স্যারের গল্প শুনে আমরাও কল্পনায় আঁকছিলাম সেই সব দিন। গল্প শুনে মাঝেমধ্যে ভয় পাচ্ছিলাম, কষ্ট হচ্ছিল; আবার কখনো বা শিহরিত হচ্ছিলাম। এরপর যা শুনলাম- 'বিজয়ের খুব কাছাকাছি। আমরা বটতৈল পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা হলো। সবাই পজিশন নিয়ে যুদ্ধ চালাতে লাগলাম। হঠাৎ তারিক ভাইয়ের চিৎকার কানে এলো। আমি রাইফেল চালানো অবস্থায়ই পেছন ফিরে তারিক ভাইকে দেখলাম। বুঝতে পারলাম বুকে গুলি লেগেছে। আমাকে ইশারা করলেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর হানাদারবাহিনী পরাজিত হয়। সবাই দৌড়ে গেলাম তারিক ভাইয়ের কাছে। তারিক ভাই ততক্ষণে মাটিতে ঢলে পড়েছেন। একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য শহিদ হলেন। কষ্টে বুকের পাঁজরটা ভেঙে এলো সবার। শোকাহত হৃদয় নিয়ে আমরা পোড়াদহে গেলাম। পোড়াদহ বাজারে গিয়ে দেখি আগের সেই থমথমে ভাব কিছুটা কমেছে। বহুদিন পর বাজারে কিছু দোকান খুলে বসেছে দোকানিরা। নারাণ দর্জির দোকান তখনও বন্ধ। বাজারের একজন গিয়ে নারাণ দর্জিকে ডেকে আনলো। তার দোকান থেকে একটা পতাকা বানানো হলো। লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে তারিক ভাইকে জড়িয়ে রাখা হলো। খবর এলো কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও ভেড়ামারায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ শেষে হানাদররা পরাজিত হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলা মুক্ত হয় সেদিন। তারিক ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। ওদিকে খালাম্মা অপেক্ষা করছেন- তার ছেলে স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা হাতে বিজয়ীর বেশে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে...'