কবিদের কবি

প্রকাশ | ১৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

মোস্তাফিজুল হক
অপু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। শুক্রবার ছুটির সকাল। সে দাদুর কাছে বসে গল্প শুনছিল। হঠাৎ সে তার দাদুকে প্রশ্ন করে বসলো, : দাদু, বঙ্গবন্ধুকে কবিদের কবি বলা হয় কেন? জবাবে দাদু বললেন, : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের দিকনির্দেশনা দিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা দেন। তার সেদিনের বক্তৃতায় তিনি এমন কিছু কথা বলেন, যা পৃথিবীর যে কোনো শ্রেষ্ঠ কবির কবিতাতেও ধ্বনিত হয়নি। তিনি অপুকে আরও বললেন, দাদুভাই, তুমি তো নিশ্চয়ই 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা' গল্পটা পড়েছ? এবার অপু বলল, : কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে এই গল্পটার সম্পর্কটা কী? তুমি কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে, দাদু? এবার দাদু অপুকে সেই গল্প নতুন করে বলতে লাগলেন, : আজ থেকে ৭০০ বছরেরও বেশি আগে জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলন যেমন সামান্য এক ভীতু প্রাণী ইঁদুরের দখলে চলে যায়, ঠিক তেমনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে ভীরু অথচ অত্যাচারী পাকিস্তানিদের দখলে চলে যায় আমাদের এই দেশ। ইঁদুরের অত্যাচারে হ্যামিলনবাসী যেমন অতিষ্ঠ হয়েছিল, ঠিক তেমনি বাঙালিরাও ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওরা প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চাইল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি প্রতিবাদ করলে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু এরপর আবারও ওরা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। বলে রাখা ভালো, কোনো উপায় না দেখে ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচতে হ্যামিলন শহরের মেয়র ঘোষণা করলেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। ঘোষণা শুনে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। সে জানালো তার বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করা সম্ভব। মেয়র বাঁশিওয়ালাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের বিনিময়ে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার আদেশ দিলেন। বড় অদ্ভুত সেই সুর শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো সব ইঁদুর। যেখানে যেরকম ইঁদুর ছিল সবই বেরিয়ে এলো মায়াবী সুরের টানে। এরপর সে সব ইঁদুর নদীতে ফেলে দিল। একইভাবে পাকিস্তানিদের দুঃশাসন থেকে রক্ষা পেতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে শাসক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাধারণ নির্বাচনের দাবি আদায় করে নিরংকুশ বিজয় অর্জন করলেন। অপু আবার প্রশ্ন করে, : দাদু এই ঘটনার সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণের কী সম্পর্ক? দাদু বললেন, : আছে দাদাভাই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ইঁদুর তাড়িয়ে তার পুরস্কার চাইলে মুখ ফিরিয়ে নিলেন শহরের মেয়র। তাই কিছুদিন পর এক উৎসবের দিনে আবার ফিরে এলো সেই বাঁশিওয়ালা। এবার তার বাঁশির সুরে বেরিয়ে এলো শহরের ছোট্ট শিশুরা। তাদের সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। ঠিক তেমনি ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও শাসকচক্র ক্ষমতা ছেড়ে দিল না। তাই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে জনসমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। সেদিন তিনি তার বক্তৃতায় বললেন, 'আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।' তিনি আরও বললেন, 'আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে হবে।' তিনি সেদিন উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।' বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শেষাংশে বলেন, প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহলস্নায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশালস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' মূলত, ৭ মার্চের এই ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি সেদিন লাখ লাখ মানুষকে আবেগময় ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেন। তার বক্তব্যে বাঙালি হৃদয়ের যে আবেগ প্রকাশিত হয়েছিল, তা প্রকৃতই কবিসুলভ। এরই ফলে বাঙালি ১৯৭১-এ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাই তো ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'নিউজউইক' পত্রিকায় লেখা হয়, 'তিনি 'লাখ লাখ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি।' অপু তার দাদুর কথা বুঝতে পারে। সে তার দাদুকে বলে, : দাদু, এক মিনিট চোখটা বন্ধ করে রাখো। এরপর দাদু যখন চোখ খুললেন, তখন দেখলেন, অপু চার লাইনের সুন্দর একটা ছুড়া লিখেছে। সে তার ছড়ায় লিখেছে, 'কবিদের কবি এক- এই পৃথিবীর, স্বাধীনতা এনে দেন কোটি বাঙালির। তিনি আর কেউ নন, শেখ মুজিবুর: মুক্তির বাণী যেন কবিতার সুর।'