তোমাদের জন্য

দিপু ও হরিণ

প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

তারিকুল ইসলাম সুমন
অনেকদিন পর বাবা-মা আর সুমি আপা মিলে গ্রামে যাবে দিপু। দিপুর জন্ম ঢাকায়। বি আই ইশকুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সে। কাল সকালেই ট্রেন। গ্রামের নাম নোয়াইলতলা। খুলনা শহর থেকেও বেশ দূরে। যে কয়েকটা দিন এখানে ওরা কাটায় খুব আনন্দ পায় দিপু। বেশির ভাগ সময়টাই দাদুর হাত ধরে কেটে যায়। ওয়াপদা বাঁধের দুই পাশে সবুজ বন। বাবলা, কুচিকদম, শিশির আর শিশু গাছগুলো বেশ বড় হয়ে উঠেছে। এগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক ফলের গাছ। নিমগাছও বেশ চোখে পড়ে। ডালে ডালে শালিক, দোয়েল, ফিঙ্গে আর বনপেঁচাদের ডাকাডাকিতে মুখরিত এই বন। অনেক গাছের নাম জানে না দিপু। এটা কি ওটা কি বলে একে একে নাম জেনে নেয় সে। দাদুও কখনো বিরক্ত হন না। এবার গ্রামে আসার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে দিপুর বাবার। কয়েকজন মিলে সুন্দরবন যাবে। দুদিন পরেই ওরা তৈরি হলো। বেশ বড় একটা ট্রলার। মাটির তৈরি একটা চুলা ও কাঠ, পানির পাত্র ও হালকা বিছানাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঠে পড়ল সবাই। ট্রলার চলতে শুরু করলে হাত নেড়ে দাদুকে বিদায় দিল দিপু। কিছু সময় চলার পর একটা ছোট শহর দেখল দিপু। বাবার কাছে জানতে চাইল 'কি নাম ওখানকার'। 'চালনা বন্দর' বাবা জবাব দিল। এভাবেই বাবার সঙ্গে কথা বলা আর দুই পাশের দৃশ্য দেখছিল দিপু। কোথাও নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে। নদীর চরে সারসের দল একপায়ে শিকারের জন্য দাঁড়িয়ে আছে কোথাও। বালিহাঁসও চোখে পড়ল। কালাবগী পার হয় ভয়াল শিবসা নদী। এখান থেকেই সুন্দরবন শুরু। দক্ষিণে যেতে শুধু সবুজ আর সবুজ। সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, বাইন, গোলপাতা প্রভৃতি গাছের মাঝে বানরের দল ছোটাছুটি করছে। চিড়িয়াখানায় হরিণ দেখেছে দিপু, মুক্ত বনে হরিণ চরে বেড়ানো এই প্রথম দেখল সে। কান খাড়া করে কয়েকটা হরিণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হরিণগুলো খুব সুন্দর তাই না বাবা? শুধু হরিণ নয়- এই বনের পাখি, বানর, কুমির, বাঘ, সাপ সবই খুব সুন্দর, বাবা হেসে জবাব দিল। খুব লম্বা একটা কেওড়া গাছ। গত সিডরে হয়তো মাথাটা ভেঙেছে। সেখানেই বসে আছে প্রকান্ড এক পাখি। মাথাটা একেবারেই টাক। বাবার কাছ থেকে ওটার নাম জেনে নিল দিপু। ওটার নাম 'মদন টাক'। বনের ভেতর থেকে দুম করে একটা আওয়াজ ভেসে এলো। ওটা যে হরিণ শিকারের আওয়াজ সবার আলোচনায় বুঝতে বাকি রইল না দিপুর। এতক্ষণে একটা হরিণ নিশ্চয় ছটফট করছে। ভাবতে খুব কষ্ট হলো দিপুর। বাবা, 'ওরা হরিণ শিকার করছে কেন?' বাবার দিকে তাকালো দিপু। এক ধরনের অসাধু লোক এই মৌসুমে হরিণ শিকারে আসে। মাংস সুস্বাদু, খুব গোপনে স্থানীয় বাজারে বিক্রিও করে থাকে। এটা খুব অন্যায়। এসব লোকের কারণেই আমাদের বন আজ সৌন্দর্য হারাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছিল দিপুর বাবা। সকালে পিউ পিউ আওয়াজে ঘুম ভাঙলো দিপুর। করমজল থেকে অনেক রূরে এসে ট্রলারটি নোঙর ফেলে এখানে রাত কাটিয়েছে তারা। বাবা এখনো ঘুমাচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে দিপু দেখল ট্রলারের মেঝেতে একটা হরিণ চার পা বাধা পড়ে আছে। বাবাকে ডাকল সে। দিপুর বাবাও খুব অবাক হলেন। ব্যাপারটা জেনে নিলেন তিনি। খুব ভোরেই ট্রলার থেকে নেমে গিয়েছিল কয়েকজন। কেওড়ার কচিপাতা পেড়ে তার নিচে শক্ত রশি দিয়ে ফাঁদ তৈরি করেছিল তারা। কচিপাতা খেতে এসেছিল অনেক হরিণ। আর তখনই আটকা পড়ে ওদের একটি। হরিণটা জবাই করার জন্য ছুরিটা ধার দিচ্ছেন একজন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দিপু। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন তিনি। তারপর হরিণটা ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন সবাইকে। প্রথম প্রথম অনেকেরই দ্বিমত ছিল পরে তিনি অনেক বোঝালেন। আমাদের সুন্দরবন আজ সপ্ত আশ্চর্য নির্বাচনের জন্য জোরালো প্রার্থী। এভাবে আমরা যদি একের পর এক হরিণ মেরে ফেলি তাহলে এই বন হরিণশূন্য হয়ে পড়বে। আর কোনো কারণে বনে হরিণ কমে গেলে বাঘের সংখ্যাও কমে যাবে। বনে বাঘ কমলে মানুষ গাছ কেটে উজাড় করে ফেলবে। এভাবে প্রভাব পড়বে সব কিছুর ওপর। সবার বিবেক যেন হঁ্যা হঁ্যা বলে উঠল। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত হলো হরিণটাকে দুবলার চরে নিয়েই ছাড়বে এবং দিপু নিজ হাতেই ওটা ছেড়ে দেবে। বাকি পথটুকু কচিপাতা খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে দিপু। কিন্তু সে কেবল মুখ লুকিয়েছে আর ভয়ে কেঁপেছে। বিকালে সবাই চরে নেমে এলো। ঠিক ছোট একটা অনুষ্ঠানের মতো। হরিণটার পায়ে বাধা রশিগুলো খুলে দিল দিপু। একসঙ্গে করতালি দিয়ে উঠল সবাই। এক দৌড়ে ছুটে পালালো হরিণটি। সুন্দরী গাছের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল গহিন বনে। খুশিতে দিপুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওর চোখ দুটো যেন অপেক্ষা করছে সপ্ত আশ্চর্যের সুন্দরবন দেখার আশায়। ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করছে দিপুর বাবা।