শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দিলে লাগে না কেন

মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি সুড়সুড়ি লাগে পায়ের তলায়। সেখানে পোকার মতো হেঁটে যাওয়া, স্পর্শ করলে কিংবা সামান্য কোনো কিছু দিয়ে স্পর্শ করলে পা কুঁচকে যায়, পায়ে কাতুকুতু লাগে, পা যেন চুলকায়! বাচ্চাদের পেটে কাতুকুতু দিয়ে আদর করা মায়েদের একটি পুরনো অভ্যাস। আর তাতে বাচ্চারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের শরীর ভেদে একেক জনের একেক জায়গায় সুড়সুড়ির সেনসিটিভিটি একেক রকম। কারও ঘাড়ে, কারও বগল তলায়, কারও নাভির আশপাশে, কারও হাঁটুর পেছনে। এই যে একেক জনের একেক জায়গায় সুড়সুড়ি একেক রকম, এটাও বিজ্ঞানীদের রহস্য।
ডা. অপূর্ব চৌধুরী
  ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

কেউ সুড়সুড়ি দিলে সবার সুড়সুড়ি লাগে। কিন্তু নিজেকে নিজেই সুড়সুড়ি দিলে তা আর লাগে না। কেন এমন হয়! কি ঘটে মস্তিষ্কে- যা আমাদের কাতুকুতু লাগার অনুভবটি থামিয়ে দেয়! আবার অন্য কেউ স্পর্শ করে বা টিকলিং করলে সুড়সুড়ির সঙ্গে আমাদের হাসিও পায় অনেক।

সুড়সুড়ি একটি রিফ্লেক্স। শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কেন এই প্রতিক্রিয়া হয়, বিজ্ঞানীরা ভালো করে জানে না। এই নিয়ে মানুষ গত দু'হাজার বছর গবেষণা করেও কূলকিনারা করতে পারেনি। গ্রিক দার্শনিক পেস্নটো থেকে জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, বিজ্ঞানী গ্যালিলিও থেকে লেখক ফ্রান্সিস বেকন, জগতের অনেকেই টিকলিং বা সুড়সুড়ির কারণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন, এই নিয়ে লিখেছেন।

উনিশ শতকে সাইকোলজিস্ট স্ট্যানলি হাল থেকে সুইডেনের বিখ্যাত কেরোলিনস্কি ইনস্টিটিউট এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট থেকে চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা চেষ্টা করেছে বুঝতে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনে বাচ্চাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সুড়সুড়ির খেলার বন্ডেজ থেকে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে এর প্রভাব।

ঘরের কুকুর বিড়ালকে সুড়সুড়ি দিলে মানুষের মতো তার শরীরও যেন হাসির দমকে দুলে ওঠে। মানুষের মতোই খিলখিল করে হাসতে থাকে শিম্পাঞ্জি থেকে গরিলা, বেবুন, ওরাংওটাং প্রাণীরাও। মানুষের জাতভাই প্রাইমেটস বিশেষ করে গ্রেট এপ্সদের মাঝে মানুষের মতোই সুড়সুড়ির সেনসেশনটি আছে। এমনকি ইঁদুরের মাঝেও এটি দেখা যায়।

মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি সুড়সুড়ি লাগে পায়ের তলায়। সেখানে পোকার মতো হেঁটে যাওয়া করে স্পর্শ করলে কিংবা সামান্য কোনো কিছু দিয়ে স্পর্শ করলে পা কুঁচকে যায়, পায়ে কাতুকুতু লাগে, পা যেন চুলকায়! বাচ্চাদের পেটে কাতুকুতু দিয়ে আদর করা মায়েদের একটি পুরানো অভ্যাস। আর তাতে বাচ্চারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। প্রাপ্ত বয়স্কদের শরীর ভেদে একেকজনের একেক জায়গায় সুড়সুড়ির সেনসিটিভিটি একেক রকম। কারো ঘাড়ে, কারো বগল তলায়, কারো নাভির আশপাশে, কারো হাঁটুর পেছনে। এই যে একেকজনের একেক জায়গায় সুড়সুড়ি একেক রকম, এটাও বিজ্ঞানীদের রহস্য।

বিস্তারিত বলার আগে একটি প্রশ্ন হয়তো মনে জাগতে পারে অনেকের। সুড়সুড়ি লাগে কেন এটা জানার উপকারিতা কি। এটি বিজ্ঞানীরা জানলে আমাদের কী উপকার হবে।

পেইন বা ব্যথা আমাদের শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া। একটি টাচ সেনসেশন। তারই একটি এই টিকলিং বা সুড়সুড়ি। মস্তিষ্কে কি করে এটি অনুভূতি তৈরি হয়, জানলে আমরা বের করতে পারব আমাদের শরীরে হাজারো ব্যথার প্রক্রিয়া মস্তিষ্কে কি করে ঘটে। সঙ্গে মস্তিষ্কের যে যে অংশগুলো এই সেনসেশন রিফ্লেক্সিটিকে কি করে নিয়ন্ত্রণ করে সেটি জানলে মস্তিষ্কের কর্টেক্স থেকে সেরিবেলাম, মস্তিষ্কের বিভিন্ন ইনজুরি থেকে এপিলেপ্সি, অটিজমে মস্তিষ্কের আন্তঃসংযোগ কী করে কাজ করে, কোথায় তার গড়বড় হয়, এমনসব জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান সহজ হয়ে যাবে। অথচ ভাবলে মনে হয় সুড়সুড়ি তো সুড়সুড়ি; করলেও হাসি পায়, শুনলেও হাসি পায়, কিন্তু এটি কেন হয়, কীভাবে হয়, কোথায় কোথায় হয়, এর রহস্যের মাঝে লুকিয়ে আছে দৈনন্দিন আরও অনেক রহস্য।

সুড়সুড়ি বা কাতুকুতু বা টিকলিং বা স্পর্শকরণ, যে নামেই বলি না কেন- ইংরেজি ঞরপশষব শব্দটি এসেছে :রপশবষবহ শব্দটি থেকে। :রশবষবহ শব্দটি এসেছে :রশবহ থেকে, যার অর্থ হালকা স্পর্শ।

সুড়সুড়ি কেন হয়, কীভাবে হয় এসব সমস্যাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়!

চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা সুড়সুড়িকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটিকে বলে নিসমেসিস, আরেকটিকে গাব্‌গেলিস। সবার সুড়সুড়ির সেনসেশন একই রকম না। এক ধরনের মানুষ শুধু স্পর্শে কাতুকুতু অনুভব করে, কোনো হাসি আসে না, আরেক ধরনের মানুষে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই কাতুকুতুর সঙ্গে হাসিও আসে প্রচন্ড। আবার আরেক ধরনের মানুষ আছে যারা এমন টিকলিংয়ে বেশ বিরক্ত হয়, হাসা তো দূরের কথা। স্পর্শ করলে শুধু স্পর্শের সেনসেশন অনুভব করলে সেটাকে নিসমেসিস বলে। নিসমেসিসের সঙ্গে হাসিও এলে তাকে গাব্‌গেলিস বলে। ইংরেজি গিগল মানে মুখ চেপে হাসা!

সুড়সুড়ি একটি টাচ সেনসেশন। এটি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স। কোথাও স্পর্শ করলে চামড়ায় থাকা টেক্টাইল সেনসেশন মস্তিষ্কের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স কালেক্ট করে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন শরীরের যে সব জায়গায় পেইন সেনসেশন খুব বেশি কাজ করে, সেখানে এমন হালকা স্পর্শ করে টাচ সেনসেশন দিলে একই নার্ভগুলো সুড়সুড়ির অনুভূতি দেয়। ব্রেইনের সোমাটোসেন্সরি এরিয়া যা শরীরের বিভিন্ন ধরনের সেন্সকে নিয়ন্ত্রণ করে, একই এরিয়াও সুড়সুড়িকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সুড়সুড়ির টাচ সেনসেশনের মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানলেও একই টাচের কারণে একেক জনের একেক প্রতিক্রিয়া এবং সবচেয়ে বড়ো কথা- বেশির ভাগের হাসি আসে কেন, এটির মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কিছুই জানে না। এটি সামাজিক কারণে হয় কিনা, এটি ছোট বেলায় মা বাবার সঙ্গে সন্তানের আদরের যে সম্পর্ক এবং বন্ধন তৈরি হয় তার কারণে হাসি আসে কিনা, এটি কোনোভাবে প্রাপ্তবয়স্কের সময় একটি সামাজিক বন্ধনের প্রক্রিয়ার কারণে হয় কিনা, এমনকি বলা হয়, সন্তান যখন মায়ের পেটে থাকে, অনেক মায়েরা পেটে স্পর্শের মধ্যে সন্তানকে এমন সুড়সুড়ি দিলে তখন বেবি তার শরীরের পজিশন চেঞ্জ করে ডিফেন্সিভ রিঅ্যাকশন হিসেবে! এমন অনেক হাইপো থিসিস দাঁড় করালেও এখনো আমাদের কাছে রহস্য যে মস্তিষ্কে কী এমন ঘটে যার কারণে কম বেশি অনেকেই হাসে! এমনকি বাচ্চারাও হাসে।

যেটি শিরোনামের কথা ছিল- নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দিলে সুড়সুড়ি লাগে না, কিন্তু একই অংশে অন্য কেউ স্পর্শ করলে সুড়সুড়ি লাগে কেন! অদ্ভুত এই প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানীদের অনেকদিন ধরে ভাবিয়েছে। সেটারও কিছু কারণ এবং প্রক্রিয়া খুঁজে পেয়েছে বিজ্ঞানীরা।

এই প্রক্রিয়াটি জানতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে আমরা আমাদের অস্তিত্ব বুঝি কেমনে। এটি যে আমার হাত এবং এটি যে অন্যের হাত, মস্তিষ্ক কি করে সেটা বুঝে! স্পর্শ তো স্পর্শই, তার আবার আপন পর কি করে হয়। নিজেরা নিজেদের হাত ঘঁষলে এক রকম লাগে, কিন্তু কেউ সেই হাতটি নিয়ে স্পর্শ করলে অন্য রকম লাগে। আর সে যদি প্রেমিক-প্রেমিকা হয় বা প্রিয় মানুষ হয়, তখন আরও ভালো লাগে! আবার একই অঙ্গে তৃতীয় অপরিচিত কেউ হাত দিলে মনে হয় হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে তাকে আঘাত করি কিংবা বিরক্ত লাগে। আমাদের অস্তিত্বটি বুঝতে সাহায্য করে মস্তিষ্কের ভেতর আরেকটি মস্তিষ্ক থাকে- সেটিকে বলে লিটল ব্রেইন বা সেরিবেলাম। এটি ঘাড়ের উপরে থাকে। এই অংশটি আমাদের সব ধরনের মুভমেন্ট এবং পারসেপশন কন্ট্রোল করে।

আপনি যখন নিজের হাত দিয়ে সেলফ টিকলিং করতে যাবেন মুহূর্তে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম সেটা আগেই জেনে গিয়ে সোমাটোসেন্সরিকে সংকেত পাঠায়। ব্রেইনের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্সের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সে আগে থেকে এমন সেন্সরের সংকেত পেলে তেমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না অথবা একেবারেই চুপ হয় যায়! কারণ সে আগেই জেনে গেছে, এমন সেন্স আসছে। যে জিনিস আগে থেকে আপনি জেনে যান সে জিনিসের অবাকের পালা থাকে না! মনে মনে আপনার প্রতিক্রিয়া থাকে কম। তেমনি আপনার হাতের মুভমেন্ট আগেই সেরিবেলাম দিয়ে কর্টেক্সে চলে যাওয়ার কারণে. নিজেকে নিজে টিকলিং করলে ব্রেইন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। কিন্তু অন্যের স্পর্শের ব্যাপারটি সেরিবেলাম আগে থেকে কখনো জানে না, কারণ অন্যের হাতের বা বাহিরের বস্তুটির ব্যাপারে তার কোনো পারসেপশন নেই। তাই অন্য কেউ এমন টিকলিং করলে ব্রেইনের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেই সুড়সুড়িটা তীব্র লাগে।

\হডা. অপূর্ব চৌধুরী

লেখক এবং চিকিৎসক, ইংল্যান্ড।

ড়ঢ়ঁৎনড়.পযড়ফিযঁৎু@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে