লিভারের অচেনা শত্রæ ফ্যাটি লিভার

ফ্যাটি লিভারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চবির্ বেশি থাকা, থাইরয়েডের সমস্যা, ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স...

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

য় যাযাদি হেলথ ডেস্ক
ফ্যাটি লিভার, লিভারের একটি খুব সাধারণ রোগ। লিভার ৫ শতাংশ পযর্ন্ত চবির্ দাহ্য করতে পারে। তবে লিভারে যদি ৫ শতাংশের বেশি চবির্ জমে থাকে, এটা ধীরে ধীরে ফ্যাটি লিভারে রূপান্তর হয়। এই লিভারে চবির্ জমে যখন লিভারের কাযর্ক্ষমতা কিছুটা নষ্ট করে দেয়, তখন লিভার এনজাইমগুলো বেশি হয়ে যায়। তখন একে বলি আমরা স্ট্যাটু হেপাটাইটিস। এই স্ট্যাটু হেপাটাইটিস দুই রকমের রয়েছে। অ্যালকোহলিক হতে পারে, নন-অ্যালকোহলিক হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষেত্রে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস খুব গুরুত্বপূণর্। তবে আমাদের দেশে নন-অ্যালকোহলিক। পশ্চিমা বিশ্বে এর প্রাদুভার্ব খুব বেশি। শতকরা প্রায় ২০ ভাগ আমেরিকান ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। জাপান ও ইতালিতে মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ থেকে ৫৮ ভাগের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। আমাদের দেশেও এই চিত্রটি, বিশেষ করে শহর এলাকায় খুব একটা অন্যরকম নয়। এ দেশের ঠিক কত শতাংশ লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত সে সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে না থাকলেও এ কথা সত্য যে আমরা প্রায়ই ফ্যাটি লিভারের রোগীদের দেখে থাকি। ফ্যাটি লিভারের কারণ বহুবিধ। ডায়াবেটিস রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝঁুকি খুবই বেশি। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৩ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে ৪৯ ভাগ ভারতীয় যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত। ফ্যাটি লিভারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চবির্ বেশি থাকা, থাইরয়েডের সমস্যা, ক্রনিক হেপাটাইটিস-সি এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। এটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ফ্যাটি লিভার সিরোসিসও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস দেখা দিতে পারে যাকে আমরা বলি স্টিয়াটো হেপাটাইটিস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সম্প্রতি আমাদের পরিচালিত এক গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এ দেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ। লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের ওপর সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আন্তজাির্তক সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী যে সব রোগীর স্টিয়াটো হেপাটাইটিস আছে, তাদের প্রায় ৩০ ভাগের পরবতীর্ সময়ে লিভারে সিরোসিস দেখা দিতে পারে। আর এদের কেউ কেউ লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন। অন্যান্য বেশির ভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মতো ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডানপাশে ওপরের দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি, দুবর্লতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা বলে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এদের প্রায় ৫০ ভাগের লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশি থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই এ কথা বলা যায় না। ফ্যাটি লিভার নিণের্য় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আল্ট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটি স্ক্যান বা এমআরআই এ ক্ষেত্রে বেশি নিভর্রযোগ্য। তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নিণের্য়র পরীক্ষাটি হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নিভুর্লভাবে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্পকের্ও একমাত্র এই পরীক্ষাটির মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায়। ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার একটি অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রæত অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে তাতে বরং হিতে-বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝঁুকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামশর্ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ওষুধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশন করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের কারণ নিণর্য় ও তার যথাযথ চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্। ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা থেকে লিভারকে রক্ষা ও পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ দেশে আমরাও এই বিষয়ে সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এ কথা ঠিক যে এখনো এজন্য শতভাগ কাযর্কর কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশকিছু ওষুধ আছে যা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণিত। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে ইনসুলিন সেন্সেটাইজারস, আরসেঅক্সিকলিক এসিড, মিটাডক্সিন, প্রোবায়োটিক্স, ভিটামিন-ই ইত্যাদি। একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হতো হাটর্ বা ব্রেনে চবির্ জমে হাটর্-অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু বিগত দশকে সেই ধারণার আমূল পরিবতর্ন এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি আজ প্রমাণিত যে ফ্যাটি লিভার, লিভারের অন্যতম প্রধান রোগ। ২০০২ সালেও যেখানে লিভার রোগের প্রধান বইগুলোয় ফ্যাটি লিভারের ওপর আলাদা কোনো চ্যাপ্টার ছিল না, সেখানে আজ লিভার রোগের যে কোনো আন্তজাির্তক কনফারেন্সে বা নামকরা জানার্লগুলোর অনেকখানিই জুড়ে থাকছে ফ্যাটি লিভার। সঠিক সময়ে এ রোগ নিণর্য় ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনতার প্রয়োজন অনস্বীকাযর্। কারণ শুরুতে ব্যবস্থা নিলে এ রোগ অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য।