শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা কেন হাই তুলি

ডা. অপূর্ব চৌধুরী লেখক এবং চিকিৎসক
  ০৯ জুন ২০২১, ০০:০০

সবাই হাই তোলে। ক্লান্ত হলে আমরা হাই তুলি। শরীর দুর্বল লাগলে হাই আসতে চায়। ঘুম পেলে আমাদের হাই আসে। কোনো কিছুতে বিরক্ত হয়ে উঠলে মুখ হা করে হাই তুলি। হাই তোলা নিয়ে সমস্যা নয়। আমরা কেন হাই তুলি। অনেকদিন থেকেই বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপারটি পাজল। মীমাংসিত কোনো উত্তর নেই, তবে অনেকগুলো উত্তর আছে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হাই তোলার কারণ হিসেবে বিশটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন।

একদিকে হাই তোলা যেমন শরীরের অবসন্নতার প্রকাশ, তেমনি অতিরিক্ত হাই তোলাও কিছু কিছু রোগের লক্ষণ। তাই হাই তোলার ব্যাপারটিকে একদিকে নরমাল ভাবলেও তার আরেকটি প্রকাশ আছে। মানুষ হাই তোলে। অন্য প্রাণীরাও হাই তোলে। দৈনিক আমরা গড়ে বিশবার হাই তুলি। সে হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় একবার। সারা জীবনে একজন মানুষ গড়ে আড়াই লাখবার হাই তোলেন। খুব ক্লান্ত থাকলে হয়তো তা আরও বেশি হয়। কিন্তু প্রতি কয়েক মিনিট পর পর কোনো ক্লান্তি ছাড়া হাই এলে শারীরিক কোনো সমস্যার লক্ষণ।

শুধু হাই তুলে ফাঁড়া কাটলে চলতো। অন্যের হাই দেখলেও নিজেদের হাই আসে। হাই শব্দটি শুনলে কিংবা পড়লেও হাই আসে। হাই তোলা ছবি দেখলেও হাই ওঠে!

ইংরেজিতে হাই হলো ণধহি। ইংরেজিতে শব্দটি সাতশ' বছর আগে প্রথম ব্যবহার দেখা যায়। এটি ওল্ড ইংলিশ যা প্রোটো জার্মান মররিধহ থেকে মরহ বাদ গিয়ে উচ্চারণে ণধহি হয়ে গেছে। শব্দটির অর্থ ছিল- বড় করে হা করা! বাংলাতেও হাই তোলা এসেছে মুখ হা করা থেকে। হাই তোলার অন্য একটি কঠিন বাংলা শব্দ আছে- জৃম্ভন!

হাই একটি শরীরের ইনভলান্টারি অ্যাকশন। একটা অনৈচ্ছিক রিফ্লেক্স। এতে ফুসফুস এবং কান একসঙ্গে কাজ করে। মুখ হা হয়ে ফুসফুসে প্রচুর বাতাস ঢুকে, সেই বাতাস মুখ দিয়ে ফুসফুসে যাওয়ার সময় কানকে চাপ দেয়। কানের সঙ্গে গলার সংযোগী একটি টিউব আছে, ওটাকে বলে ইস্টাশিয়ান টিউব। এটি মধ্যকানের সঙ্গে নাক ও গলার একটি সংযোগ তৈরি করে। এই জন্য সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে গেলে অনেক সময় কানও বন্ধ হয়ে যায়! বাতাসের চাপে একদিকে বাহিরের কানের ইয়ার ড্রাম প্রসারিত হয়, অন্যদিকে মধ্যকানের টেনসর টিম্পানি মাসলটি সঙ্কুচিত হয়। এমন সঙ্কোচনের কারণে হাই দিলে একটা মড় মড় শব্দ হয় চোয়ালে! এই শব্দ শেষ হতেই ফুসফুস থেকে একগাদা বাতাস বেরিয়ে আসে। গোটা প্রক্রিয়াটি যেন শরীরে বাতাসের একটি ঝড়। কখনো কখনো হাই তোলার সঙ্গে চোখে জল আসে, কানে একটি শব্দ বাজে, শরীরের কিছু মাসল এবং হাত-পাগুলো টানটান হয়ে উঠে।

হাই তুললে শরীরে দুটো প্রক্রিয়া ঘটে। একটি শারীরিক। আরেকটি মানসিক। শারীরিকভাবে মুখ খুলে যায়, অনেক বড় করে হা করি আমরা। প্রচুর বাতাস ঢুকে তাতে। তারপর আমরা গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেই। সব শেষে একরাশ বাতাস ছাড়ি।

হাইয়ের মানসিক দিকটি হলো- হাই তোলার পর আমরা মানসিক প্রশান্তি লাভ করি। আমাদের মন মস্তিষ্কে একটি আয়েশ এবং প্রশান্তির ভাব আসে। একটু মুখ খুলে আর বাতাসে ভর করে আমাদের কী এক ভালো লাগা জড়িয়ে ধরে। কখন হাই তোলে বেশি মানুষ। ঘুম থেকে উঠে কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার সময়। ঘুমের প্রস্তুতি নেই, তারপরেও হাই আসে। ক্লান্তিতে হাই আসে। মানসিক অস্বস্তিতে অনেকক্ষণ থাকলে হাই আসে। ঘন ঘন হাইয়ের সঙ্গে শারীরিক কিছু সমস্যা জড়িত। যদি প্রতি মিনিটে একটি করে হাই আসে, ধরে নিতে হবে শরীরে কোনো সমস্যা চলছে। তখন এটি শুধু ক্লান্তি বা ঘুমের কারণে হয় না। এমন অন্যতম একটি হলো- ভেসোভেগাল রি-অ্যাকশন। ভেগাস নার্ভ অতিরিক্ত স্টিমুলেটেড হলে এই ভেসোভেগাল রি-অ্যাকশন হয়। তাতে হাই তোলা অত্যধিক পরিমাণ বেড়ে যায়, সঙ্গে হার্ট বিট কমে যায়, বস্নাড প্রেসার অনেক কমে যেতে পারে। তাই অতিরিক্ত হাই তোলার সঙ্গে হার্টের কোনো সমস্যাকে আড়ালের কারণ হিসেবে ধরা যায়।

হাই তোলা সবচেয়ে বেশি হয় ফ্যাটিগ বা ক্লান্ত হলে, ঝিমুনি এলে, ঘুম এলে, অথবা ঘুমজনিত কোনো সমস্যা, যেমন : স্স্নিপ এপনিয়া কিংবা নারকোলেপ্সি হলে, কিছু মেডিসিন খেলে অতিরিক্ত হাই আসতে পারে, যেমন : ডিপ্রেশনের জন্য খাওয়া সেরোটোনিন ইনহিবিটরি জাতীয় ওষুধ। কোনো কারণে হৃৎপিন্ডে কিংবা হৃৎপিন্ডের আশপাশে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ঘন ঘন হাই আসতে পারে।

এসবের বাহিরে ডায়াবেটিসে রক্তে সুগার বেড়ে গেলে, ব্রেন টিউমার হলে, হার্ট অ্যাট্যাকের সম্ভাবনা থাকলে তার আগ মুহূর্তে, এপিলেপসি হলে, লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে ঘন ঘন হাই তোলার সমস্যাটি দেখা দিতে পারে।

হাইয়ের সঙ্গে শরীরের অনেকগুলো অংশে কিছু পরিবর্তন ঘটে। শরীরের অনেক সিস্টেমও হাইয়ের সঙ্গে নড়ে ওঠে। বিশেষ করে হাত-পা, পেট, চোয়াল, মুখ, চোখ, এমনকি মস্তিষ্ক। হাই শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলে, হার্ট এবং ফুসফুসের ওপর ইফেক্ট করে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, যা মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অবস্থিত, থার্মোরেগুলেশনের ওপর হাই তোলার প্রভাব আছে। কিছু হরমোন, যেমন কর্টিসল, হাই তুললে শরীরে বৃদ্ধি পায়।

হাই কতক্ষণ থাকে। মানুষের হাই গড়ে পাঁচ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। হাই খুব সংক্রামক। হাই দেখলে হাই আসে, হাই শব্দটি শুনলেও হাই আসে। হাই তোলার ছবি দেখলেও হাই আসে। এক পরীক্ষা এবং গবেষণায় দেখা গেছে, যার সঙ্গে সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ, তার হাইয়ের প্রভাব পাশের জনের ওপর তত বেশি।

তাহলে মানুষ বা প্রাণী হাই তুলে কেন

হাই তোলার ডজন কারণকে চিহ্নিত করেছে বিজ্ঞানীরা। সব কারণগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়; যেমন- শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কারণ।

শরীরে ঘুম পেলে, ক্লান্ত হলে, দুর্বল লাগলে, কিছু রোগ হলে হাই আসে। হাই তোলা ঘুমের কারণে এলেও হাইয়ের কারণ ঘুম নয়। ঠিক তার উল্টো। ঘুম পেলে শরীর সতর্ক হয়ে উঠে হাই তুলে আরও জেগে থাকতে। হাই তোলায় শরীরের সিস্টেম শরীরকে সজাগ করে তুলে। হাইয়ের সামাজিক কারণ সহানুভূতি। অন্যের হাই দেখলে নিজেদের শরীর তার হাইয়ের সঙ্গে কমন একটি কানেকশন ফিল করে এম্পেথি থেকে। সামাজিক এই সহানুভূতি হুতি অজান্তে শরীরে সামাজিক কানেকশন তৈরি করে।

হাইয়ের একটি অন্যতম শারীরিক কারণ মস্তিষ্ক। ক্লান্ত হয়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। তাতে ব্রেইনে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরীণ কাজের ফসল কার্বন ডাই-অক্সাইড ঠিকই বাড়তে থাকে! এমন অসামঞ্জস্য হলে ব্রেন সিগন্যাল দেয় হাই তোলার! তাতে অধিক পরিমাণ অক্সিজেন শরীরে ঢুকে মুখ হা করার মাধ্যমে! ফুসফুস থেকে দ্রম্নত মস্তিষ্কে যায় রক্তের মাধ্যমে এবং দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে নিয়ে আসে! মস্তিষ্ক চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সঙ্গে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে হাইয়ের ভূমিকা আছে। প্রয়োজনের তুলনায় কোনো কারণ ছাড়াই অধিক পরিমাণে হাই তুললে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে