শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফুসফুসে ক্যানসারের কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

সুস্বাস্থ্য ডেস্ক
  ১৩ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

বহুকোষী প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মৃতু্যবরণ করে। আর এই পুরনো মৃত কোষগুলোর স্থানে নতুন তৈরি হওয়া কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমাফিক বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়।

তবে যখন এই কোষগুলো ক্যানসার সহায়ক অনকোজিন সক্রিয় হওয়ার কারণে অথবা ক্যানসার দমনকারী জিন নিষ্ক্রিয় থাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকে; তখনই সেই স্থানে মাংসের জমাটবাঁধা অথবা চাকা দেখা যায়। যাকে বলা হয় টিউমার।

এই টিউমার বিনাইন কিংবা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই ক্যানসার নামে পরিচিত। অর্থাৎ নিওপস্নাস্টিক বা টিউমার কোষ উচ্চহার বিশিষ্ট আক্রমণাত্মকতা, মেটাস্টাসিস এবং শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যানসার বলে অভিহিত করা হয়।

ফুসফুসের ক্যানসার

উপরোক্ত বিষয়গুলো ফুসফুুসে সংঘটিত হলে তাকে বলা হয় ফুসফুুসীয় ক্যানসার। শ্বাসতন্ত্রের যাবতীয় রোগের মধ্যে ফুসফুুসের ক্যানসার সবচেয়ে মারাত্মক। আমাদের দেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঠিক পরিসংখ্যান তেমন নেই।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৯১ হাজার মানুষ। মৃতু্যবরণকারী ব্যক্তিরা প্রধানত ফুসফুুস, কোলোরেক্টাল, পাকস্থলী, লিভার, স্তন, খাদ্যনালি, প্যানক্রিয়াস ও জরায়ুমুখ ক্যানসরে ভুগেই মারা যান সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে শনাক্ত মোট ক্যানসার রোগীর প্রায় ১৬ শতাংশই ফুসফুুসের ক্যানসরে আক্রান্ত। ফুসফুুসীয় ক্যানসার ফুসফুুসের শ্বাসনালি, বায়ুথলি ও মিউকাস গস্ন্যান্ডের এপিথেলিয়াম ইত্যাদি যে কোনো কোষ থেকেই সৃষ্টি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার শুধু ফুসফুুসেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা লসিকাগ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গে (যেমন মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ক্যানসার কোষের ওপর নির্ভর করে ফুসফুুসের ক্যানসারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- স্মল সেল কারসিনোমা ও নন-স্মল সেল কারসিনোমা। নন-স্মল সেল কারসিনোমাকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা (৩৫ শতাংশ), এডেনোকারসিনোমা (৩০ শতাংশ)এবং লার্জ সেল কারসিনোমা (১৫ শতাংশ)।

ফুসফুসের ক্যানসরের কারণ

বিশ্বব্যাপী পুরুষের মৃতু্যর প্রথম কারণ ফুসফুুসের ক্যানসার, আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় কারণ। গ্রামের চেয়ে শহরবাসীরাই ফুসফুুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হন বেশি। অবশ্য এর পেছনে যথাযথ কারণও বিদ্যমান- গ্রামের চেয়ে শহরে যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, বায়ুদূষণ, ধুলোবালি সবকিছুই অনেক বেশি।

অজৈব পদার্থের ক্ষুদ্র কণা বা আঁশ যেমন- এসবেস্টস, নিকেল, ক্রোমিয়াম এবং জৈব পদার্থ যেমন- বেনজিন, বেনজোপাইরিন ইত্যাদি বায়ুর সঙ্গে ফুসফুুসে প্রবেশ করে ফুসফুুসের ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। ফুসফুুসের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারই এর জন্য দায়ী। ফুসফুুসের ক্যানসারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপায়ী ও তামাকসেবী। দিনে ২০টি করে ৪০ বছর সিগারেট খেলে ফুসফুুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীর তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি। নিয়মিত ধূমপায়ীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মল সেল ক্যানসার হতে দেখা যায়। ফুসফুুসের অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় এটি বেশি মারাত্মক এবং অপেক্ষাকৃত দ্রম্নত শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ

ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো কাশি। কাশি যদি আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় সঙ্গে বুকে ব্যথা থাকে তাহলে সাবধান হতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুুসের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি দেখা যায়। তবে কাশির সঙ্গে কফ তৈরি হবেই, এমন কোনো কথা নেই।

কারণ খুশখুশে কাশিও হতে পারে ফুসফুুসের ক্যানসারের লক্ষণ। কাশির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া ফুসফুুস ক্যানসারের আরেকটি লক্ষণ। ধূমপায়ী পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে এ লক্ষণটি আরও বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও ক্যানসার কোষ শ্বাসনালির কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্টও।

তদুপরি দীর্ঘদিন গায়ে জ্বর থাকা, হঠাৎ করে ডায়েট বা ব্যায়াম ছাড়াই প্রায় ৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমে যাওয়া, ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কর্কশ বা খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্লান্তি বা অবসাদবোধ, দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতিও হতে পারে ফুসফুুসের ক্যানসারের লক্ষণ।

ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্তকরণ

ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বুকে এক্স-রে করা হয়। মাইক্রোস্কোপের নিচে কফ বিশ্লেষণের মাধ্যমেও অনেক সময় ক্যানসার কোষের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। তবে ক্যানসার শনাক্তের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বায়োপসি।

যেখানে অস্বাভাবিক কোষ বা টিসু্যর পর্যবেক্ষণ বা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। প্রচলিত বায়োপসিগুলোর মধ্যে ব্রংকোস্কপি, মেডিয়াস্টিনোস্কপি, নিডল বায়োপসি ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। ফুসফুসীয় ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করার আগে ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে- তা নির্ণয় করা হয়। ক্যানসারের ধরন, অবস্থান ও আকার, স্টেজিং, গ্রেডিং এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়।

ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসা পদ্ধতি

ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপি উলেস্নখযোগ্য। কিছু ক্ষেত্রে এই তিন ব্যবস্থার সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাও অবলম্বন করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি দিন দিন টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপির ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে ফুসফুুসের ক্যানসারের চিকিৎসায়।

টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করা হয় ক্যানসার কোষের সুনির্দিষ্ট মিউটেশনকে লক্ষ্য রেখে; যেন চিকিৎসার ফলে শরীরের সুস্থ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলা হয়। যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা গেলে অস্ত্রোপচার করে শুধু টিউমার ও সংলগ্ন অংশ অপসারণ করে ফেলে দেওয়া যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ফুসফুুস বা এর অংশবিশেষ অপসারণের প্রয়োজন হয়। সার্জারির পদ্ধতিগুলোর মধ্যে লোবেক্টোমি, নিউমোনেক্টোমি, লিম্ফেন্ডেনেক্টোমি ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য।

রেডিয়েশনের ক্ষেত্রে সাধারণত উচ্চশক্তিসম্পন্ন এক্স-রে এবং অন্যান্য তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করা হয়। কেমোথেরাপিতে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হয়। তবে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দুর্বলতা, বমি ভাব, চুল পড়ে যাওয়া, ডায়রিয়া, মুখে ঘা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং খাবারের তালিকায় নিয়মিত তাজা ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে। উচ্চ ক্যারোটিনয়েড ও সালফোরাফেনযুক্ত খাবার যেমন- গাজর, কমলা, ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি, ব্রকোলি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

তবে ফুসফুুসের ক্যানসার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধূমপান না করা ও তামক সেবন থেকে বিরত থাকা। এমনকি ধূমপায়ীর কাছে অবস্থান করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। শিল্পকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া নির্গমন গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে