শরীর ব্যথা ও ওজন বৃদ্ধি স্ট্রেসের লক্ষণ!

কথায় বলে স্ট্রেস আসলে মারাত্মক কিছু নয়, তবে এর প্রভাবে আমরা যে প্রতিক্রিয়া করি বরং তাই ক্ষতিকর। আসলেই তাই। ব্যক্তিভেদে স্ট্রেস ভিন্নরূপে ধরা দেয়। কেউ হয়তো রেগে যাবে, কেউ বা দুঃখ পাবে। তৃতীয় পক্ষ কাউকে টানলে দেখা যাবে সে ভয় পাচ্ছে। একই পরিস্থিতি একেকজন মানুষের কাছে একেক অনুভূতির পসরা নিয়ে আসে...

প্রকাশ | ০২ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কথায় বলে স্ট্রেস আসলে মারাত্মক কিছু নয়, তবে এর প্রভাবে আমরা যে প্রতিক্রিয়া করি বরং তাই ক্ষতিকর। আসলেই তাই। ব্যক্তিভেদে স্ট্রেস ভিন্নরূপে ধরা দেয়। কেউ হয়তো রেগে যাবে, কেউ বা দুঃখ পাবে। তৃতীয় পক্ষ কাউকে টানলে দেখা যাবে সে ভয় পাচ্ছে। একই পরিস্থিতি একেকজন মানুষের কাছে একেক অনুভূতির পসরা নিয়ে আসে। তাই স্ট্রেস কি বা কি ঘটল সেই ঘটনার মাপকাঠিতে বিচার বিবেচনা না করে নির্দিষ্ট একজন মানুষ সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে কি অনুভব করছে সেই নিরীক্ষে বিশ্লেষণ করতে হবে। স্ট্রেস হলো তার সেই নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষটির অনুভূত নিজস্ব অনুভূতি। স্ট্রেসের কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। কাজেই মানসিক স্ট্রেসে আক্রান্ত হলে এখন থেকে সচেতন থাকবেন আপনার শারীরিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়া মনো-দৈহিক। মানে স্ট্রেস হলে দেহের চাপ নিচ্ছে। কেন মাংসপেশি ব্যথা করছে তা নিয়ে ভেবে বিস্মিত হচ্ছেন? আপনার স্ট্রেস লেভেলের দিকে তাকান। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ট্রেস (মানসিক চাপ) মানসিক সমস্যার চেয়েও বেশি কিছু- স্ট্রেস জমে মারাত্মক শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। স্ট্রেস কি? যে কোনো ধরনের অবস্থা থেকে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যেমন- কাজ সম্পর্কিত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক অবস্থা অথবা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। ফোর্ট লাউডারডেলের ফ্যামিলি কাইরোপ্র্যাক্টর লিলি ফ্রেইডম্যান বলেন, 'আমরা বর্তমানে দ্রম্নত জীবনযাপন করছি এবং দ্রম্নতগামী, নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি আমাদের স্ট্রেস বাড়াচ্ছে। আমি বর্তমানে আমার রোগীদের কাছ থেকে স্ট্রেসের বিষয়ে বেশি অভিযোগ শুনি- আমি ১৮ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছি।' আমাদের নতুন সংস্কৃতি এবং দ্রম্নত পরিবর্তনশীল জীবনধারায় স্ট্রেসে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া আগের তুলনায় সহজ। আপনি ঘনঘন ফেসবুকের ইনবক্স চেক করেন? আপনি কি কোনো ভালো কারণ ছাড়াই তাড়ার মধ্য থাকেন? আপনি এর জন্য আমাদের দ্রম্নতগামী প্রযুক্তি সৃষ্ট মানসিকতাকে দায়ী করতে পারেন। ইন্টিগ্রেটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এলিজাবেথ ট্রেটনার স্ট্রেসের শারীরবৃত্তীয় কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এবং তিনি এটাও বলেছেন যে এটি আমাদের শরীরে কি করতে পারে। তিনি বলেন, 'যখন আমরা স্ট্রেসে ভুগি, আমাদের শরীরে করটিসল নামক একটি হরমোন তৈরি হয়। আমাদের পৃথিবীতে আগমন থেকে হাজার হাজার বছর ধরে এটি আমাদের ওয়্যারিংয়ের একটি অংশ হয়ে আসছে। ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্সের (লড়ো নয়তো মরো প্রতিক্রিয়া) জন্য এটিকে ডিজাইন করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের শরীর কোনো ভালস্নুক থেকে দৌড়ে পালানো এবং কোর্টরুমে হাঁটার মধ্যে পার্থক্য জানে না।' স্ট্রেস কোথায় প্রকাশ পায়? উচ্চমাত্রায় করটিসল উৎপাদনের প্রতিক্রিয়া আমাদের সারা শরীরে অনুভূত হতে পারে। ডা. ট্রেটনার বলেন, শরীরের মধ্যভাগে (কোমর) ওজন বৃদ্ধি হিসেবে স্ট্রেস প্রকাশ পায়, যেখানে অন্যান্য প্র্যাকটিশনাররা বলেন যে বিভিন্ন স্থানে স্ট্রেস জমা হয়, যেমন- ঘাড়, মাথা ও কাঁধ। ডা. ফ্রেইডম্যান বলেন, শরীরে স্ট্রেস বাস্তব। আমি এটিকে দৈনিক ভিত্তিতে দেখি। এটি লিঙ্গ, পেশা, বয়স ইত্যাদির মধ্যে বৈষম্য করে না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্থানভেদে স্ট্রেস প্রকাশের প্রাধান্যতা থাকতে পারে।' তিনি বলেন, পুরুষরা প্রায় সময় নিম্নস্থ পিঠের ব্যথা হিসেবে স্ট্রেস অনুভব করে, নারীদের সাধারণত উপরিস্থ পিঠ, ট্রেপিজিয়াস মাংসপেশি ও ঘাড়ে স্ট্রেস জমা হয়। এটি প্রায়ই অক্সিপিটাল হেডেকের (উপরিস্থ ঘাড় বা মাথার পেছনে ব্যথা) কারণ হতে পারে। এমনকি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের শরীরেও স্ট্রেস জমা হয়। ডা. ফ্রেইডম্যান বলেন, 'তাদের বেশির ভাগ স্ট্রেস জমা হয় ঘাড় ও মধ্যপিঠে। এর জন্য প্রতিনিয়ত সেলফোন ব্যবহার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযোগকে দায়ী করা যায়।' স্ট্রেসের আরও শারীরিক প্রকাশের মধ্যে মাথাব্যথা, হজম সমস্যা, মাংসপেশি ব্যথা ও সারা শরীরে ব্যথা অন্তর্ভুক্ত। সাইকোফিজিওলজিক ডিসঅর্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. ডেভিড ক্লার্ক বলেন, 'মাথাব্যথা, নিচের পিঠে ব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, পরিপাক ও অন্ত্রীয় সমস্যা সর্বাধিক কমন, কিন্তু এ ছাড়া আরও সমস্যা হতে পারে।' শরীর কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়? মেডিকেল সাহায্য (যেমন- নিয়মিত কায়রোপ্র্যাক্টিক অ্যাডজাস্টমেন্ট অথবা হালকা ব্যথানাশক) ছাড়াও কি আপনাকে স্ট্রেস দিচ্ছে তা সম্পর্কে কথা বলা আপনার শারীরিক সমস্যার উপসর্গ উপশম করতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে, উন্মুক্ত ও নিরাপদ উপায়ে (যেমন- থেরাপি) স্ট্রেসের মূল কারণ প্রকাশ স্ট্রেসের শারীরিক উপসর্গ নিরাময়ে সাহায্য করে। ডা. ফ্রেইডম্যান বলেন, 'অনেক রোগী পিঠ বা ঘাড় ব্যথা নিয়ে আমার অফিসে আসে এবং তারা আমার টেবিলে শুয়ে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা কাটায়। তারা চিকিৎসা গ্রহণের সময় আমার সঙ্গে কথা বলে। তারা অফিস থেকে যাওয়ার সময় বলে যে তাদের শরীর থেকে যেন ভারী বোঝা নেমে গেছে। তারা তাদের সব হতাশা টেবিলেই রেখে দেয়!' এই শারীরিক মুক্তি ও মানসিক মুক্তির সমন্বয় হচ্ছে আপনার উপসর্গ উপশম করা এবং জমে থাকা স্ট্রেস দূর করার সর্বোত্তম উপায়। কিন্তু ক্রনিক ব্যথার কারণ হতে পারে আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যেমন- ট্রমা অথবা অ্যাংজাইটি। ডা. ক্লার্ক বলেন, 'মুক্তির চাবিকাঠি হচ্ছে স্ট্রেসের উৎস শনাক্ত করা, যদিও অনেকে এটাকে যতটা সহজ মনে করে ততটা সহজ নয়। শারীরিক উপসর্গ সৃষ্টি করে এমন অবিবেচিত স্ট্রেসের মধ্যে আত্মসেবার দক্ষতায় ঘাটতি, শৈশবের প্রতিকূলতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব, ডিপ্রেশনের অনির্ণীত কারণ, পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) ও অ্যাংজাইটি উলেস্নখযোগ্য।' সর্বোত্তম প্র্যাকটিস কি? প্রফেশনাল নিউরোফিজিওলজিক্যাল সাহায্য ছাড়াও আপনার ব্যথা উপশম করতে এবং দ্রম্নত স্ট্রেস কমাতে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন। ডা. ফ্রেইডম্যান স্ট্রেস কমানোর জন্য হালকা এক্সারসাইজ যেমন- যোগব্যায়াম বা জগিং, প্রকৃতির মাঝে হাঁটা ও মেডিটেশন সুপারিশ করছেন। এমনকি ছুটি কাটানোর পরিকল্পনাও আপনাকে ভালো অনুভবে সাহায্য করতে পারে। স্ট্রেস কমাতে কিছু হার্বাল চিকিৎসাও রয়েছে। ডা. ট্রেটনার অন্যান্য করটিসল-হ্রাসকারী কৌশল সুপারিশ করছেন। তিনি বলেন, 'আমি রোগীদের তাদের শরীরকে রিচুয়াল বা ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান, উৎসব, রান্না বা এক্সারসাইজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পরামর্শ দিই। এসব কিছু করটিসল হ্রাস করে এবং হরমোন অক্সিটোসিন (ভালো অনুভূতির হরমোন) বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সাধারণত এসব ক্রিয়ার ফল দেখতে প্রায় এক মাস লাগতে পারে, কিন্তু এসব বিষয় আসলেই করটিসল কমাতে ভূমিকা রাখে।' আপনার শরীরকে পুনরুদ্ধার করতে এবং স্ট্রেসের মাত্রা কমাতে এসব পদক্ষেপ অনুসরণ হচ্ছে নিজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো অনুভব এ পৃথিবীকে আপনার কাছে আরও সুন্দর করে তুলবে। তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট