মাথার যত ব্যথা

বেশিরভাগ মাথাব্যথাই গুরুতর নয়, তবে কিছু কিছু মাথাব্যথা অনেক বিপজ্জনক ও জটিল রোগের উপসর্গ হতে পারে। হেলাফেলা না করে মাথাব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মানুষ তার জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশিবার যে উপসর্গটির সম্মুখীন হয় তা হচ্ছে মাথাব্যথা। সাধারণত মাথার বিভিন্ন অংশ, মুখ বা ঘাড়ের ব্যথাকে মাথাব্যথা হিসেবে গণ্য করা হয়। মাথাব্যথার নানান রকমফের থাকলেও টেনশনের কারণেই বেশিরভাগ মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ মাথাব্যথাই গুরুতর নয়, তবে কিছু কিছু মাথাব্যথা অনেক বিপজ্জনক ও জটিল রোগের উপসর্গ হতে পারে। হেলাফেলা না করে মাথাব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। সাধারণত ১৫০-এর বেশি ধরনের মাথাব্যথা দেখা গেছে। এর মধ্যে কমন যেসব মাথাব্যথার রোগী ফিজিশিয়ানরা পেয়ে থাকেন সেগুলো সবার জানার জন্য তুলে ধরা হচ্ছে: টেনশন হেডেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সবচেয়ে কমন একটি মাথাব্যথা। এক্ষেত্রে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ব্যথা হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসে এবং যায়। সঙ্গে অন্য কোনো উপসর্গ সাধারণত থাকে না। মাইগ্রেনের মাথাব্যথা প্রায়ই ঝাঁকুনি, কম্পনকারী (টাকাস টাকাস) ব্যথা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এ ধরনের মাথাব্যথা সাধারণত ৪ ঘণ্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং মাসে এক থেকে চারবার হতে পারে। ব্যথার পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গ যেমন আলো, শব্দ বা নির্দিষ্ট কোনো গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা; বমি বমি ভাব বা বমি; ক্ষুধামন্দা এবং পেটে ব্যথা হতে পারে। ছোটদের ক্ষেত্রে যখন মাইগ্রেন এর ব্যথা হয়, তখন তারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মাথা ঘোরা অনুভব করতে পারে এবং দৃষ্টি ঝাপসা, জ্বর এবং পেট খারাপ হতে পারে। অল্পসংখ্যক বাচ্চাদের মাইগ্রেনের মধ্যে হজমের লক্ষণগুলো দেখা যায়, যেমন বমি, যা সাধারণত মাসে একবার হয়ে থাকে। ক্লাস্টার মাথাব্যথা এই ধরনের মাথাব্যথা সবচেয়ে গুরুতর। সাধারণত এক চোখের পেছনে বা চারপাশে তীব্র জ্বলন বা সুঁইয়ের আঘাতের মতো ব্যথা হতে পারে। এটি থ্রবিং বা স্থায়ী ধরনের ব্যথা এবং এতটাই খারাপ ধরনের যে, ক্লাস্টার মাথাব্যথায় আক্রান্ত বেশিরভাগ ব্যক্তি স্থির হয়ে বসেও থাকতে পারে না। ব্যথার পাশাপাশি চোখের পাতা ঝিমিয়ে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখের মনি ছোট হয়ে যাওয়া এবং চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে। সেই পাশের নাকের ছিদ্রটি বন্ধ মনে হয় এবং সর্দি আসতে পারে। এটাকে ক্লাস্টার মাথাব্যথা বলা হয়; কারণ, উপসর্গগুলো একসঙ্গে ঘটে থাকে। সাধারণত ক্লাস্টার সময়কাল প্রতিদিন এক থেকে তিনবার হতে পারে- যা ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ ধরনের প্রতিটি মাথাব্যথার স্থায়িত্বকাল ১৫ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়। ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে, আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের তিন থেকে চার গুণ বেশি এ ধরনের মাথাব্যথা হতে দেখা যায়। দীর্ঘস্থায়ী দৈনিক মাথাব্যথা (ক্রনিক ডেইলি হেডেক্স) এই ধরনের মাথাব্যথা মাসে ১৫ দিন বা তার বেশি, সাধারণত ৩ মাসের বেশি সময় ধরে থাকে। কিছু কিছু ব্যথা অল্প সময় আবার কিছু কিছু ব্যথা ৮ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়। এটি সাধারণত নিম্নোক্ত চার ধরনের প্রাইমারি মাথাব্যথার একটি হিসেবে গণ্য করা হয় : হ দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেন হ দীর্ঘস্থায়ী টেনশন মাথাব্যথা হ নতুন দৈনিক ক্রমাগত মাথাব্যথা (নিউ ডেইলি পারসিস্টেন্স হেডেক) হ হেমিক্রানিয়া কন্টিনুয়া সাইনুসাইটিস সাইনাসের ইনফেকশনের কারণে এ ধরনের মাথাব্যথা হয়ে থাকে। সাইনাস হচ্ছে মাথার হাড়ের ফাঁপা স্ফীত গহ্‌বর বিশেষ। এ ক্ষেত্রে গালের হাড়, কপালে বা নাকে তীব্র এবং অবিরাম ব্যথা অনুভূত হয়। সাইনুসাইটিসের ব্যথার সঙ্গে সাধারণত অন্যান্য উপসর্গ যেমন নাক দিয়ে পানি পড়া, কানে ইনফেকশন, কান ভারী ভারী লাগা, জ্বর এবং মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি হয়ে থাকে। এটি যেহেতু সাইনাসের ইনফেকশনের ফলে হয় সেহেতু নাক থেকে বের হওয়া সর্দির রং হলুদ বা সবুজ রঙের হয়। ক্লাস্টার বা মাইগ্রেনের কারণে মাথাব্যথায় স্বচ্ছ পানির রঙের মতো সর্দি দেখা যায়। আঘাতজনিত মাথাব্যথা পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস মাথাব্যথা সাধারণত মাথায় আঘাতের ২ থেকে ৩ দিন পরে শুরু হয়। \হব্যথার উপসর্গগুলো হচ্ছে : হ এটি মাথা চেপে ধরা ব্যথা যা সময়ের সঙ্গে তীব্র হতে থাকে হ ভার্টিগো বা মাথা ঘুরায় হ মাথা শূন্য শূন্য লাগে হ সব কাজে মনোযোগের ঘাটতি থাকে হ স্মৃতিভ্রম (মেমরি লস) হতে পারে হ সব সময় ক্লান্তি অনুভূত হয় হ মেজাজ খিটখিটে হয় এক্সারসাইজ বা পরিশ্রমের কারণে মাথাব্যথা পরিশ্রমরত অবস্থায় মাথা, ঘাড় এবং মাথার ত্বক ও পেশিগুলোর বেশি বেশি রক্তের প্রয়োজন হয় এবং তা সরবরাহ করার জন্য রক্তনালিগুলো স্ফীত হয়ে যায়। ফলে মাথার উভয় পাশে এক ধরনের স্পন্দিত ব্যথা অনুভূত হয়- যা ৫ মিনিট থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি সাধারণত পরিশ্রমরত অবস্থায় বা তার ঠিক পরে অনুভূত হয়। সহবাসের পরেও এ ধরনের ব্যথা হতে পারে। হেমিক্রানিয়া কন্টিনুয়া এটি দীর্ঘস্থায়ী, চলমান মাথাব্যথা- যা সবসময় মুখ এবং মাথার একই পাশে হয়ে থাকে। এই ধরনের মাথাব্যথার সঙ্গে অন্যান্য নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো থাকে : হ ব্যথার তীব্রতা সময়ের সঙ্গে তীব্রতর হয় হ চোখ লাল হয়ে যায় কিংবা চোখ অশ্রম্নসজল হয় হ সর্দি লাগা বা নাক ঠাসা হ চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া হ চোখের মনি ছোট হয়ে আসে হ ইনডোমেথাসিন জাতীয় ব্যথার ওষুধে ব্যথা কমে যায় হ শারীরিক পরিশ্রমে ব্যথা বাড়তে থাকে হ অ্যালকোহল পানে ব্যথা বাড়ে হ কারো কারো ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের উপসর্গগুলোও লক্ষ্য করা যায়, যেমন : বমি বমি ভাব এবং বমি; শব্দ ও আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা। হরমোনের কারণে মাথাব্যথা পিরিয়ড, গর্ভাবস্থা এবং মেনোপজের (মাসিক বন্ধ অবস্থা) সময় হরমোনের মাত্রা পরিবর্তনের ফলে মাথাব্যথা হতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এবং হরমোন রিপেসমেন্ট থেরাপির কারণে হরমোনের তারতম্যেও মাথাব্যথা হতে পারে। ব্যথা যদি মাসিকের ২ দিন আগে বা মাসিক শুরু হওয়ার প্রথম ৩ দিনের মধ্যে হয়, তখন তাকে মিন্সট্‌রুয়াল মাইগ্রেন বলা হয়। নতুন দৈনিক অবিরাম মাথাব্যথা (নিউ ডেইলি পারসিস্টেন্স হেডেক্স) এই ধরনের মাথাব্যথা হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং ৩ মাস বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়। এই ব্যথার কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, যে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুস্থতা, সার্জারি কিংবা মানসিক চাপের কারণে এ ধরনের মাথাব্যথা হয়ে থাকে। ব্যথা সাধারণত মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে, তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি এতটাই গুরুতর হয় যে, প্রায়শই চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। লক্ষণগুলো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেনশন মাথাব্যথার মতো মনে হয়। আবার কেউ কেউ মাইগ্রেনের লক্ষণগুলো, যেমন বমি বমি ভাব বা আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা এরকম কমপেস্নইনও করে। রিবাউন্ড মাথাব্যথা সাধারণত ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে হয়ে থাকে। যদি রোগীরা কোনো প্রেসক্রিপশনের ওষুধ বা ওভার-দ্য-কাউন্টার ব্যথা উপশমকারী ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছা মতো বেশি করে গ্রহণ করেন তবে তিনি নিজেকে মাথাব্যথার জন্য তৈরি করছেন। যখন ওষুধগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন আবার ব্যথা ফিরে আসে এবং ব্যথা বন্ধ করার জন্য তখন অন্য কোনো ওষুধ নিতে হয়। এটি চেপে ধরা টাইপ, অবিরাম মাথাব্যথার কারণ হতে পারে- যা প্রায়শই সকালের দিকে তীব্রতর হয়। আইস পিক মাথাব্যথা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী, ছুরিকাঘাতকারী, তীব্র মাথাব্যথা যা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এ ধরনের ব্যথা দিনে কয়েকবার হতে পারে। এ ধরনের মাথাব্যথা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে- কারণ এটি সাধারণত অন্য কোনো গুরুতর রোগের উপসর্গের ইঙ্গিত দেয়। স্পাইনাল মাথাব্যথা সাধারণত স্পাইনাল কর্ডের আঘাত, স্পাইনাল বস্নকের কারণে বা এপিডুরাল টাইপের হয়। সিজারিয়ান ডেলিভারির পরে বা পেটের যে কোনো সার্জারির পরে রোগীরা এ ধরনের ব্যথার কমপেস্নইন করে থাকে। বজ্রপাতের মতো মাথাব্যথা (থান্ডারক্লাপ হেডেক) যা মানুষ প্রায়শই জীবনের সবচেয়ে খারাপ মাথাব্যথা বলে থাকে। এ ধরনের মাথাব্যথা হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং দ্রম্নত তীব্র আকার ধারণ করে। বজ্রপাতের মতো মাথাব্যথার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: হ রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া হ রক্তনালি ফেটে যাওয়া বা বস্নকেজ হ মাথার আঘাত হ মস্তিষ্কের ফেটে যাওয়া রক্তনালি থেকে হেমোরেজিক স্ট্রোক হ মস্তিষ্কের বস্নকড রক্তনালি থেকে ইস্কেমিক স্ট্রোক হ মস্তিষ্কের চারপাশের রক্তনালি সরু হয়ে রক্তনালিতে রক্তচাপ পরিবর্তন হওয়া হ গর্ভাবস্থা মাথাব্যথা তা যেমনই মনে হোক, অবশ্যই গুরুত্তের সঙ্গে নিতে হবে। কেননা, আপনার কাছে যা সাধারণ মাথাব্যথা তা হয়তো একমাত্র সতর্ক সংকেত যা গুরুতর কোনো রোগের উপসর্গ। \হডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নীলফামারী সদর, নীলফামারী।