মাইগ্রেন: কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি হেলথ ডেস্ক
মাইগ্রেন হলে তীব্র মাথাব্যথা হয়- যা সাধারণত মাথার একদিকে বা পেছনের দিকে অনুভূত হয়। তবে চোখের চারপাশে হতে পারে। সাধারণভাবে এটিকে আমরা আধকপালি মাথাব্যথাও বলি। মেয়েদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা দেয়, তবে পুরুষেরও হতে পারে। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে এ রোগ শুরু হয়। মাইগ্রেন মাথাব্যথা হলে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। এটি একদিকে শুরু হয়ে সারা মাথা ছড়িয়ে পড়ে। নারী ও পুরুষের এই অনুপাত ৫:১। মাইগ্রেন কি? : মাইগ্রেন হলো এক বিশেষ ধরনের অসহণীর মাথাব্যথা। এটি গ্রিক শব্দ 'হেমোক্রেনিয়া' হতে এসেছে যার অর্থ অর্ধ মাথার খুলি বা করোটি। এটি প্রথমে অর্ধ মাথায় হয়ে থাকে। এর পরে সারা মাথা ছড়িয়ে পড়ে। এতে মাথায় স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। মাথার বহিরাবরণে যে ধমনিগুলো আছে, সেগুলো মাথাব্যথার শুরুতে স্ফীত হয়ে যায়। যাদের মাইগ্রেন হওয়ার প্রবণতা বেশি তাদের শব্দ, আলো ও গন্ধ সবই অসহ্য লাগে। মাথাব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমিও হতে পারে। কখনো কখনো চোখে ঝাপসাও দেখা যায়। কেন ও কাদের বেশি হয়? : মাথার ভেতরে রক্ত চলাচলের তারতম্যের কারণে মাইগ্রেন মাথাব্যথা হয়। রক্ত চলাচল কমে গেলে চোখে অন্ধকার দেখায় তারপর হঠাৎ রক্ত চলাচল বেড়ে গেলে প্রচন্ড মাথাব্যথা অনুভূত হয়। মাইগ্রেন কেন হয়, তা এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। অনেক কারণেই মাইগ্রেন হতে পারে। যেমন: বংশগত বা জেনেটিক, অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তা, পরিবেশের প্রভাব, জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ ও হরমোন। এ ছাড়াও আরো কিছু কারণেও হতে পারে। যেমন- মদ্যপান, ধূমপান। পনির, চকোলেট, কফি, কোমলপানীয়, প্রচন্ড শীত, অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত আলোতে কাজ করা, বেশি সময় কম্পিউটার মনিটর ও টিভির সামনে থাকা, মাসিকের সময়, হঠাৎ বিপজ্জনক খবর বা আবেগ প্রবণ হলে। মোবাইলে কথা বলা বা বেশি কথা বলা, অতিরিক্ত ভ্রমণ, ব্যায়াম। আবার মাইগ্রেন রোগী কিন্তু পাশাপাশি সাইনাস প্রদাহেও ভুগছে বা সর্দি কাশি বা ঠান্ডায় ভুগছেন। তাদের ব্যথা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার শীতকালে কুয়াশা পরিবেষ্টিত অবস্থায় মাইগ্রেনের মাথাব্যথা বেড়ে যায়। প্রকারভেদ ও লক্ষণাবলি: মাইগ্রেনকে বেশ কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে সাধারণ ক্ল্যাসিক্যাল, ব্যাসিলার আর্টারি, অপথেলমোপ্লেজিক, হেমিপ্লেজিক ও ফেমিওপ্লেজিক মাইগ্রেন ইত্যাদি। এদের মধ্যে কমন ও ক্ল্যাসিক্যাল মাইগ্রেনই বেশি দেখা যায়। সাধারণ মাইগ্রেন : সাধারণ মাইগ্রেনই বেশি দেখা যায়। এই ব্যথা ৪-৭২ ঘণ্টাব্যাপী হয়। সাধারণ মাইগ্রেনে নিম্নলিখিত লক্ষণাবলি লক্ষণীয় হতে পারে- অর্ধেক মাথায় ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, দপদপ বা চিনচিন করে মাথাব্যথা। শব্দ ও আলো ভীতি। এ ধরনের মাথাব্যাথায় কানের ওপরে চাপ দিলে, কপাল টিপলে ও মাথার চুল টানলে আরাম বোধ হয়। ক্ল্যাসিক্যাল মাইগ্রেন : এটিও বেশি দেখা যায়। প্রথম পর্যায়ে চোখের সামনে আলো ঝলকানি ও চোখ ঝাপসা হতে পারে। হাত, পা ও মুখের চারপাশে ঝিনঝিনে ব্যথা অনুভূতিসহ শরীরের একপাশে দুর্বলতা ও অবশ হতে পারে এরপর প্রচন্ডভাবে মাথাব্যথা শুরু হয়। প্রথমে এক পাশ হতে শুরু হয়ে মাথায় সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর দপদপে মাথাব্যথা, শরীরে প্রচুর ঘাম হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে। কখনো কখনো চোখের দৃষ্টির সমস্যা নিয়ে এ রোগ দেখা দিতে পারে। তখন অবশ্য মাথাব্যথা নাও থাকতে পারে। লক্ষ্য করতে হবে দৃষ্টির সময় ১ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে ধরে নিতে হবে এটি মাইগ্রেন নয়, ব্রেইন বা চোখের অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। ব্যাসিলার আর্টারি মাইগ্রেন : এ ধরনের মাথাব্যথা মাথার পেছন দিক হতে শুরু হয়। এতে মাথাঘোরা ভাবও থাকতে পারে। অপথেলমোপ্লেজিক মাইগ্রেন : এ ধরনের মাথাব্যথায় চোখের উপরিভাগ হতে শুরু করে মাথার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঝাপসা দেখে। আলোর প্রতি তাকাতে পারে না ফলে অন্ধকার ঘরেই থাকতে ভালো লাগে। হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন : এ মাথাব্যথায় শরীর অবশ হয়ে যায়। এ ধরনের ব্যথা বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়। মাইগ্রেনের মাথাব্যথার পূর্বের লক্ষণাবলি : মাথাব্যথা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে কয়েক দিন পূর্বের অবস্থাতে হতে পারে। এ সময় মানসিক ও স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে। এ সময় রোগী খিটখিটে, অতি উৎসাহী, শান্ত ধীরগতি, বিষণ্ন্ন, উলস্নসিত, ঝিমুনি, অতি সচেতন ভাব হতে পারে। অনেক সময় বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। এ লক্ষণগুলো আমরা হয়তো এড়িয়ে চলি। তবে এগুলো শনাক্ত করে অতিদ্রম্নত চিকিৎসা নেয়া জরুরি। মাইগ্রেন মাথাব্যথার পরে লক্ষণাবলি : মাথাব্যথা শেষ হওয়ায় পর রোগী অত্যন্ত ক্লান্ত ও দুর্বলতা বোধ করে। ক্ষুধামন্দা ও মনোরোগের সমস্যা হতে পারে। কিভাবে হয় : বিশেষজ্ঞরা এই মাথাব্যথার জন্য একটি হরমোনকে দায়ী করেছেন, সেটি হলো সেরোটোনিন। মেকানিক্যাল কারণে বহিঃমস্তিষ্কের ধমনীগুলোর প্রসারণ ঘটে। তবে সেরোটোনিন ও মেকানিক্যাল কারণে যখন কোষগুলোর উদ্দীপিত হতে থাকে, তখনই ব্যথা অনুভূত হয়। রোগ শনাক্তকরণ : এ রোগে সাধারণত রোগীর দেয়া উপসর্গ ভিত্তিতেই শনাক্ত করা যায়। তবে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাইনাসের প্রয়োজনীয় এক্স-রে, চোখ পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি করা যেতে পারে। কি ধরনের খাবার এড়িয়ে চলবেন? চা, কফি, কোমলপানীয়, চকোলেট, আইসক্রিম, দুধ, দই, মাখন খাবেন না। টমেটো ও টক জাতীয় ফল খাবেন না। গম জাতীয় খাবার যেমন- রুটি ও ব্রেড ইত্যাদি এড়িয়ে চলবেন। আপেল, কলা ও চিনাবাদাম খাবেন না। পেঁয়াজ খাবেন না। ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন খাবারে সমস্যা হতে পারে। তাই যে খাবার খেলে সমস্যা হচ্ছে সেটি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কোন কোন খাবার খাবেন : সবুজ, হলুদ ও কমলা রংয়ের শাক-সবজি, ফলমূল খাবেন। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডিসমৃদ্ধ খাবার খাবেন। ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। গ্রিন টি, আদার রস খাবেন। খেজুর ও ডুমুর জাতীয় খাবার খাবেন। মাইগ্রেন হতে মুক্তি পেতে কি করবেন : দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা যাবে না। রোগীকে প্রত্যহ অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুম অত্যাবশ্যকীয়। মদ, ধূমপান পরিহার করতে হবে। জন্ম বিরতিকরণ পিল ব্যবহার না করে অন্য কোন উপযোগী পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত বা কম আলোতে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তীব্র ঠান্ডা ও কড়া রোদ দুটোই এড়িয়ে চলতে হবে। কোলাহলপূর্ণ এলাকা, উচ্চ শব্দ এড়িয়ে চলতে হবে। দীর্ঘ ভ্রমণ, মানসিক চাপ ও পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে হবে। দীর্ঘক্ষণ টিভি ও কম্পিউটারের সামনে না থাকা। নিজে নিজে ব্যথা কমাতে যা করবেন : বমি বমি ভাব কাটাতে ১ টুকরা আদা মুখে দিন ব্যথা অনেকটা লাঘর হবে। মাথাব্যথা বেশি হলে বরফের টুকরা একটা আইসব্যাগে নিয়ে ব্যথাযুক্ত স্থানে দিয়ে রাখুন তাতেও ব্যথা কমে যাবে। গ্রিন টির সঙ্গে আদা কুচি ও লেবু দেয়া হলে ব্যথার প্রকোপ অনেকটাই কমে আসবে। অতিরিক্ত আলোময় স্থানে না থেকে ঘর অন্ধকার করে ঘুমিয়ে নিন। এতে ব্যথা অনেকটাই কমে আসবে। আরামদায়কভাবে বসে বা শুয়ে নাক দিয়ে বড় করে শ্বাস নিন, আস্তে আস্তে মুখ দিয়ে ছাড়ুন। এভাবে ৫ থেকে ১০ বার গভীর শ্বাস নিলে শরীর হালকা হয়ে যাবে। রেহাই পাবেন মাইগ্রেনের মতো তীব্র যন্ত্রণা থেকে। চিকিৎসা : চিকিৎসা মানেই ওষুধ নয়। দরকার নিয়ম মেনে চলা ও সচেতন হওয়া। মনে রাখা উচিত সব মাথাব্যথাই কিন্তু মাইগ্রেন নয়। মাথার টিউমার, মাথায় রক্তক্ষরণ দৃষ্টি স্বল্পতার কারণেও মাথাব্যথা হতে পারে। হোমিওপ্যাথিক লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই সঠিক লক্ষণের প্রতি মনোযোগ দিলেই ভালো চিকিৎসা করা সম্ভব। হোমিও মতে গেস্নানয়িন, স্যাঙ্‌গুনেরিয়া, নাক্স, স্পাইজেলিয়া, আইরিস, ক্যানাবিস স্যাট, ন্যাট মিউর, ন্যাজা, সাইলিসিয়া, সিপিয়া, সাইক্ল্যামেন, ইপিকাক, ক্যাকটস, চেলিডোনিয়াম, ল্যাকেসিস, আর্সেনিক মেট, এমন পিক্রেটাম, ককুলাস, ব্রায়োনিয়া, থুজা, সিমিসিফুগা, জিঙ্কাম, ম্যাগ ফস, ক্যাল ফস, বেলেডোনা, অনসমোডিয়াম, একোনাইট, ক্যাল ফস প্রভৃতি ওষুধ প্রয়োগ করে মাইগ্রেনের মতো তীব্র যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।