বোবায় ধরা কী, কেন হয় পরিত্রাণ পাবেন কীভাবে

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

য় সুস্বাস্থ্য ডেস্ক
ফারজানা ইয়াসমিনের বয়স ত্রিশের কোটায়। প্রায় রাতেই তিনি গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং তার মনে হয় শরীরের ওপর যেন ভারী কিছু চাপ দিয়ে আছে, সেটা এতটাই ভারী যে, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। এমনকি পাশে কেউ থাকলে তাকেও ডাকতে পারেন না। 'ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়। মনে হয় যে, আমার কোনো শক্তি নেই। নিজের হাত-পা নাড়ানোর মতো, মুখে আওয়াজ করার মতো শক্তিটাও পাই না। অনেক চেষ্টা করলে গোঙানির মতো শব্দ হয়।' মনে হয় যেন, এই বোধহয় দম আটকে মারা যাব। মাত্র কয়েক সেকেন্ড এই অবস্থাটা লাস্টিং করে। কিন্তু তাতেই মনে হয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এত ভয়ঙ্কর ওই সময়টা। যার না হয় সে কখনোই বুঝবে না। এমন অভিজ্ঞতার কথা আমাদের আশপাশে আরও অনেকের কাছ থেকে শোনা যায়। যা অনেকে বোবায় ধরা বলে থাকেন। বোবায় ধরা কী? চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয় স্স্নিপ প্যারালাইসিস, বা ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত। স্স্নিপ প্যারালাইসিস হলে একজন ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্য কথা বলা বা নাড়াচাড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এটি সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে ওই সময়টায় মানুষ ভীষণ ঘাবড়ে যান, ভয় পেয়ে যান। বোবায় ধরা বা স্স্নিপ প্যারালাইসিস হলে গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা। ঘুমের ওই পর্যায়টিকে বলা হয়র্ যাপিড আই মুভমেন্ট-রেম। রেম হলো ঘুমের এমন একটি পর্যায় যখন মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় থাকে এবং এ পর্যায়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। কিন্তু সে সময় শরীরের আর কোনো পেশি কাজ করে না। এ কারণে এ সময় মস্তিষ্ক সচল থাকলেও শরীরকে অসাড় মনে হয়। স্স্নিপ প্যারালাইসিস তরুণ-তরুণী এবং কিশোর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বোবায় ধরা কাদের হয়, কেন হয়? স্স্নিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। এই পরিস্থিতি যে কারও সঙ্গে যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা বা এনএইএসের তথ্য মতে তরুণ-তরুণী এবং কিশোর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্স্নিপ প্যারালাইসিস হওয়ার পেছনে কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছে তারা। ১. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা ছেড়ে ছেড়ে ঘুম হওয়া। অসময়ে ঘুমানো। অনেক সময় কাজের সময় নির্দিষ্ট না হলে, অথবা দূরে কোথাও ভ্রমণে গেলে এমন ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ২. মাদকাসক্ত হলে অথবা নিয়মিত ধূমপান ও মদপান করলে। ৩. পরিবারে কারও স্স্নিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকলে। ৪. সোশ্যাল অ্যাঙ্কজাইটি বা প্যানিক ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে। বোবায় ধরার লক্ষণ ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী স্স্নিপ পারালাইসিসের সাধারণ কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো হলো: ১. বড় করে নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। মনে হবে যেন বুকের মধ্যে কিছু চাপ দিয়ে আছে। দম বেরুচ্ছে না। ২. অনেকের চোখ খুলতে এমনকি চোখ নাড়াচাড়া করতেও সমস্যা হয়। ৩. অনেকের মনে হয় যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু তাদের আশপাশে আছে, যারা তার বড় ধরনের ক্ষতি করতে চায়। ৪. ভীষণ ভয় হয়। শরীর ঘেমে যায়। ৫. হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। অনেকের রক্তচাপও বাড়তে পারে। ৬. পুরো বিষয়টা কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। প্রভাবটি কেটে গেলে আগের মতো কথা বলা বা নড়াচড়া করায় কোনো সমস্যা থাকে না। তারপরও অনেকে অস্থির বোধ করেন এবং পুনরায় ঘুমাতে যেতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এর চিকিৎসা স্স্নিপ প্যারালাইসিস আসলে গুরুতর কোনো রোগ নয়। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। মনকে চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি ঘুমানোর অভ্যাসে ও পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সাধারণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ১. রাতে অন্তত ৬ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা এবং সেই ঘুম যেন গভীর হয়। ২. প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করা। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও। ৩. ঘুমের জন্য শোয়ার ঘরটিতে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। যেন সেই ঘরে কোলাহল না থাকে, ঘরটি অন্ধকার থাকে এবং তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় থাকে, খুব বেশি না আবার কমও না। সম্ভব হলে ঘরে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। ৪. ঘুমাতে যাওয়ার আগমুহূর্তে ভারী খাবার সেইসঙ্গে ধূমপান, মদ পান এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ৫. ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত চার ঘণ্টা আগে ব্যায়াম করার চেষ্টা করা। ৬. ঘুমের সময় হাতের কাছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ অর্থাৎ ঘুমের বাধা হতে পারে এমন কোনো বস্তু রাখা যাবে না। ৭. দিনের বেলা দীর্ঘসময় ঘুম থেকে বিরত থাকতে হবে। ৮. স্স্নিপ প্যারালাইসিস হলে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে হবে যে ভয়ের কিছু নেই, এই পরিস্থিতি সাময়িক, কিছুক্ষণ পর এমনই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়ে শরীর নাড়াচাড়া করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এসব নিয়ম মেনে চলার পরও যদি কারও বাড়াবাড়ি রকমের স্স্নিপ প্যারালাইসিস হয় অর্থাৎ আপনার ঘুমে নিয়মিতভাবে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা, স্স্নিপ প্যারালাইসিস ঘন ঘন হলে উদ্বিগ্নতার কারণে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যায়, যা বড় ধরনের স্বাস্থ্য-ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। চিকিৎসক রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক সময় তারা কম থেকে বেশি মাত্রার অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। চিকিৎসা পদ্ধতি নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা মূলত এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তারা ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম-ইএমজি পরীক্ষা করে থাকেন। এখানে মূলত মাংসপেশির ইলেকট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। যেটা কি না স্স্নিপ প্যারালাইসিসের সময় অনেক কমে যায়। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে স্স্নিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্তদের অনেকেরই দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব হয়। সে সময় চিকিৎসকরা রোগীর এই দিনের বেলার ঘুম পরীক্ষা করে থাকেন। যাকে বলা হয় ডে-টাইম ন্যাপ স্টাডি এবং এর পরীক্ষাটিকে বলা হয় মাল্টিপল স্স্নিপ ল্যাটেন্সি টেস্ট। স্স্নিপ প্যারালাইসিসের সময় মস্তিষ্ক জেগে উঠলেও শরীর তখনও শিথিল থাকে। এর কারণ হিসেবে কানাডার দুই গবেষক জানিয়েছেন যে, মস্তিষ্কে দুই ধরনের রাসায়নিক বা অ্যামাইনো অ্যাসিডের নিঃসরণের কারণে মাংসপেশি অসাড় হয়ে পড়ে। রাসায়নিক দুটি হলো, গস্নাইসিন এবং গামা অ্যামাইনোবিউটিরিক অ্যাসিড-গ্যাবা। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া এল ব্‌রুকস এবং জন এইচ পিভার, পিএইচডি একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে নিউরোট্রান্সমিটার গ্যাবা এবং গস্নাইসিন মস্তিষ্কে পেশি সক্রিয় রাখার কোষগুলোকে 'সুইচ অফ' করে দেয়।