সাক্ষাৎকার

ত্বকের রোগ সোরিয়াসিস

মানব দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ ত্বক। যা দ্বারা সম্পূর্ণ দেহ আবৃত থাকে। তবে ত্বক সংক্রমিত হওয়া বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগের মধ্যে সোরিয়াসিস অন্যতম একটি চর্মরোগ। যেটিতে দেশের অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র সচেতন হওয়ার পাশাপাশি রোগটি প্রতিরোধে চর্মরোগ চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি রোগটি নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের 'চর্ম ও যৌন রোগ' বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সহকারী অধ্যাপক ডা. রেবেকা সুলতানা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন যায়যায়দিন প্রতিনিধি জাহিদ হাসান

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ডা. রেবেকা সুলতানা
যাযাদি: সোরিয়াসিস কী? এ রোগের কারণ কী? সোরিয়াসিস হলো ছোট থেকে বড় হওয়া বিভিন্ন আকারে রুপালি বর্ণের আঁশের ন্যায় এক ধরনের ত্বকের অসংক্রামক ব্যাধি। এটা মূলত অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত এক ধরনের ইমিউন ডিসফাংশন। যেটি বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। এতে চামড়ার বাইরের স্তরের কোষের বিভাজন ত্বরান্বিত হয়। ফলে চামড়া বারবার খোলস পাল্টায়। বংশগত কারণ হিসেবে বাবা মায়ের মধ্যে কেউ একজন এ রোগে আক্রান্ত হলে সন্তানদের ৮ শতাংশ এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ই আক্রান্ত হলে সে ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়াও নানা কারণে ব্যাক্টরিয়াজনিত সংক্রমণ, ধূমপান, স্থূলতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা, অ্যালকোহল জাতীয় ওষুধ গ্রহণ ও বিভিন্ন কারণে ট্রমাটাইজ বা আক্রান্তগ্রস্ত ব্যক্তি সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যাযাদি: এ রোগের লক্ষণগুলো কী কী? ত্বকে আক্রমণের স্থানভেদে লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে মাথার কিছু কিছু স্থানে বড় বড় চামড়া ওঠা। যেটা টেনে তুললে সামান্য রক্ত বের হয়। তবে রোগের বিস্তৃতি ঘটলে সমস্ত মাথা থেকে চামড়া উঠতে পারে। যেটিকে অনেকে মাথায় খুশকি বলে ভুল করে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন গিঁটের ওপরে যেখানে বেশি ঘর্ষণ লাগে যে সব জায়গার চামড়া কম পুরু হয়ে উঠতে পারে। ঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রদাহ বেশি হলে শরীর লাল হয়ে যায়। ব্যথা হতে পারে। হাতে পায়ের আঙুলের গিঁটা বাঁকা হয়ে যেতে পারে। আবার সোরিয়াসিস যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে যায় তখন জটিলতা বেড়ে প্রচন্ড চুলকানি হয়। অনেক সময় এটা হাতে ও পায়ের তালুতে সীমাবদ্ধ থাকে। যাযাদি: সোরিয়াসিস ছোঁয়াচে কি না? এ থেকে ক্যান্সারের সম্ভাবনা কতটুকু? সোরিয়াসিস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রোগীর সঙ্গে সারাজীবন কাটালেও অন্যজনের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সঠিক সময় শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা না হলে জটিল রূপ ধারণ করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ ও রক্ত শূন্যতা থেকে শুরু করে হার্ট ফেইলর পর্যন্ত হতে পারে। যাযাদি: রোগীর সংখ্যা ও রোগ শনাক্তের হার কেমন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সারাবিশ্বে ১২৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ সোরিয়াসিসে ভুগছেন। বাংলাদেশে সোরিয়াসিস রোগীদের কোনো পরিসংখ্যান বা জরিপ নেই। তবে সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাবের সদস্যভুক্ত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে কাজ করছেন। তাদের মতে বিভিন্ন কারণে গত ২০ বছরে সোরিয়াসিস আক্রান্তের হার প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাচ্ছে। এমনকি গত সেপ্টেম্বর মাসে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের বহির্বিভাগে প্রায় ১৭ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শতকরা দুইভাগ রোগী সোরিয়াসিসে আক্রান্ত ছিল। গ্রামঞ্চল থেকে শহরে এ রোগের প্রকোপ বেশি। যাযাদি: সোরিয়াসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন? প্রথমত, রোগের ধরনভেদে রোগীকে কিছুটা ধারণা দেয়া জরুরি। এটা ইমিউনোমেডিটেড জাতীয় রোগ হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়া শুষ্ক হয়ে যায়। তখন মশ্চেরাইজার (নারিকেল তেল, অলিভ ওয়েল, ভ্যাজলিন) লাগিয়ে ত্বক নরম ও মসৃণ করতে হয়। এর বাইরেও চিকিৎসকরা প্রয়োজনভেদে আক্রান্ত স্থানে লাগানোর জন্য কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন। যেমন, স্টেরয়েড, কোলটার, সোলিসাইলিক এসিড ও মুখে খাওয়ার ওষুধ ইত্যাদি। এ ছাড়া সাধারণ চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে সে ক্ষেত্রে রোগীকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়। যাযাদি: রোগ শনাক্তকরণ, সুবিধা ও চিকিৎসা ব্যয় কেমন? চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া যায় কি না? সোরিয়াসিস শনাক্তকরণ খুব সহজ। সাধারণত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা রোগীর চোখ দেখেই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে সমস্যা হলো রোগীরা প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসে না। বিভিন্ন রকমের অপচিকিৎসার পরে যখন আসে, ততক্ষণে রোগের ধরন বদলে যায়। তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করতে হয়। অন্যদিকে দেশে এ রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে একজন করে চর্ম ও যৌন রোগের কনসালট্যান্ট আছেন। তাদের থেকে সঠিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রোগী ভালো থাকতে পারেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে প্রায় সব ধরনের ওষুধের সরবরাহ রয়েছে। যাযাদি: সোরিয়াসিস প্রতিরোধের উপায় কী? সোরিয়াসিস থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে দরকার সচেতনতা। তাই রোগীর পরিবার, সমাজ ও সবার সহায়তায় সোরিয়াসিস থেকে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। পাশাপাশি তাদের কিছু উপদেশ মেনে চলা উচিত যেমন, ত্বক সবসময় ময়েশ্চারাইজ করে রাখা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা। সাবান ব্যবহারে কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলা- যেমন, সপ্তাহে দুই থেকে তিনবারের বেশি সাবান বা শ্যাম্পু ব্যবহার না করা। ধুলোবালি ও অতিরিক্ত রোদ পরিহার করা। সর্বোপরি আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত থাকার চেষ্টা করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলা। যাযাদি: খাদ্যাভাসে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? কিছু কিছু খাবার আছে যা সোরিয়াসিস বাড়িয়ে তোলে যেমন: লাল মাংস, ডিম, ডিমের তৈরি খাবার, পাস্তা, নুডুলস, আটার তৈরি খাবার, শস ও অ্যালকোহল জাতীয় খাদ্য পরিহার করা। এসবের পরিবর্তে বেশি করে তাজা ফলমূল যেমন চেরী, আঙ্গুর, তাজা সবজি, কড লিভার (তেল জাতীয় সামুদ্রিক মাছ) এবং ভিটামিন ডি জাতীয় সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।