তরুণদের অতিরিক্ত চুল পড়া রোগ : চলিস্নশেই চালসে

চুল পড়া রোগ ও আধুনিক চিকিৎসা

ট্রাইকোলজিস্ট বা চুল চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি চুল পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এর বেশি হলে বা পুনরায় নতুন চুল না গজালে চিকিৎসকরা এটিকে এক ধরনের রোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে দেশের তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে অনেকের চুল পড়া সমস্যা বাড়ছে। এ সমস্যার সমাধানে অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রিত মানহীন কসমেটিক ব্যবহার করে অনেকে ভুল চিকিৎসারও শিকার হচ্ছেন। ফলে চুল পড়া রোধে আধুনিক চিকিৎসা যেমন- পিআরপি থেরাপি, হেয়ার ট্রান্সপস্নান্ট, হেয়ার সার্জারি বা চুল প্রতিস্থাপন দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে চুল পড়া ও তার চিকিৎসা বিষয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের 'চর্ম ও যৌন রোগ' বিভাগের কনসালটেন্ট ডার্মাটোলজিস্ট, হেয়ার টান্সপস্নান্ট ও কসমেটিক সার্জন ডা. জাহেদ পারভেজ।

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

প্রতিনিধি জাহিদ হাসান
যাযাদি: চুল পড়ার কারণগুলো কি? জাহেদ পারভেজ : মানুষের চুল পড়ার কারণগুলোর মধ্যে ফিজিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল সমস্যা অন্যতম। এ ছাড়া মানুষের দেহে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা ও ভিটামিন ডি'র ঘাটতি হলে চুল পড়ে থাকে। কারণ দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা অতিরিক্ত ওজন (স্থূলতা ও মেদ) কমাতে অনিয়ন্ত্রিত ডায়েট কন্ট্রোল করে। আবার আরেক শ্রেণি অর্থাৎ গরিব মানুষ আছে যারা শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য পায় না। ফলশ্রম্নতিতে অ্যানিমিয়া হয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল পড়ে। এর বাইরে আরও কয়েক ধরনের চুল পড়া রোগ আছে যেমন- অনেকের আকস্মিক চুল, ভ্রূ ও দাড়ি কমে যায়, চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় যাকে অ্যালোপেশিয়া এরিয়েটা বলা হয়। অনেকের চুল-দাড়ি, চোখের পাতা সব পড়ে যায় যেটিকে অ্যালোপেশিয়া ইউনিভার্সেলিস বলে। এ দুটি লক্ষণকে বলা হয় অটোইমুইন ডিজিজ। এ ছাড়াও ভার্টিগো বা শ্বেতী রোগ, বোলাস ডিজিজ, কিডনি বিকল ও ক্যান্সারের কারণে চুল পড়ে থাকে। যাযাদি: চুল পড়ার জন্য বাংলাদেশের পরিবেশ কতটা দায়ী? জাহেদ পারভেজ : দেশে কর্ম ও পরিবেশগত কারণে অনেক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটে যেমন- দীর্ঘক্ষণ ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশে অবস্থান, নিয়মিত হেলমেট ব্যবহারে অতিরিক্ত মাথা ঘামা, নিদ্রাহীনতা, হেয়ার স্টাইলে পরিবর্তন অর্থাৎ চুল সোজা বা বাঁকা করতে নিম্ন-মানের জেল, ক্রিম, সিরাম জাতীয় কসমেটিক ব্যবহার, ইলিট্রিক হিট, হিয়ার রিবন্ডিং ও কালার করা ইত্যাদি চুল পড়ার জন্য দায়ী। এর বাইরে অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া বা বংশগত কারণ ও বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও চুল পড়ে থাকে। পরিবেশগত ও জিনগত কারণে চুল পড়ার পাশাপাশি মানুষের শরীরে টেস্টস্টোরেন নামক এক প্রকার হরমোন আছে। যে উপাদানটি বাংলাদেশের মানুষের শরীরে বেশি দেখা যায়। প্রকৃতির নিয়মে এটি শরীরে মধ্যে ভেঙে ডিএইচটি বা ড্রাই-হাইড্রো টেস্টোস্টেরেন তৈরি করে। আর বংশত কারণে যাদের শরীরে বেশিমাত্রায় ডিএইচটি উৎপন্ন হয় তাদের চুলও বেশি পড়ে। (ডিএইচটি মূলত মাথার চামড়ার রক্তনালির ভেতরে জমা হয়ে রক্ত (খাদ্য) খেয়ে ফেলে। ফলে কিছুদিন পর মাথার অনেক জায়গায় চুল গজানো কমে যায় এবং পূর্বের চুলগুলো পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে।) যাযাদি: কাদের বেশি চুল পড়ে? জাহেদ পারভেজ : বংশগত টাক পড়ার প্রবণতা বেশি হওয়ায় ছেলেদের চুল পড়ার হার বেশি। কারণ নারীদের তুলনায় পুরুষদের হরমোনাল বিষয়, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বেশি পরিবর্তন হয়। সমীক্ষা করে দেখা গেছে, শুধু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চুলের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে শতকরা ৭০-৭৫ জনই ছেলে। প্রতিদিন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বহির্বিভাগে গড়ে ৩০ জনের মতো রোগী চুলের সমস্যা নিয়ে আসছে। এই হিসেবে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ চুলের চিকিৎসা নিতে আসছে। যাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশেরই ইনজেকশন নেওয়া বা ট্রান্সপস্নান্টের প্রয়োজন হয়। যাযাদি: চুল পড়ার আধুনিক চিকিৎসা কি আছে? খরচ কেমন? জাহেদ পারভেজ : কারো বংশগত কারণে চুল পড়লে প্রাথমিক অবস্থায় এটি রোধ করতে ও পুনরায় চুল গজাতে সাহায্য করে এমন কিছু ওষুধ যেমন- ওয়েন্টমেন্ট (মলম) ও মুখে খাওয়ার ইনস্টোরয়েড, ডুটামেক্স জাতীয় ক্যাপসুল দেয়া হয়। তাতে কাজ না হলে থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে পস্নাটিলেট রিচ পস্নাজমা বা পিআরপি থেরাপি, মাইক্রোনিডিলিং থেরাপি অর্থাৎ মেশিনের সাহায্যে চুলের গোড়া শক্ত করার পদ্ধতি, স্টিমসেল থেরাপি (মাথার ভেতরে এক ধরনের ইনজেকশন) দেয়া হয়। এ ছাড়া যাদের মাথা একেবারে টাক হয়ে গেছে স্থায়ী সমাধানের জন্য তাদের হেয়ার ট্রান্সপস্নান্টের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে একবার পিআরপি থেরাপি দিতে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা লাগে। অন্যদিকে কেউ ১ হাজার (প্রতিটা গোড়ায় গড়ে ৩টা করে চুল থাকে) চুল ট্রান্সপস্নান্ট করালে ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। যাযাদি: চিকিৎসার কার্যকরিতা কেমন? জাহেদ পারভেজ : বংশগত কারণ ছাড়া অন্যান্য কারণে চুল পড়া রোগের চিকিৎসার কার্যকরিতা প্রায় শতভাগ। বংশগত কারণে চুল পড়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিলে ওষুধ সেবনকালীন সময়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। পরে ছেড়ে দিলে পূর্বের অবস্থা হতে পারে। তবে হেয়ার ট্রান্সপস্নান্ট করালে সেটির কার্যকরিতা শতভাগ। যাযাদি: চুল পড়া রোধের প্রতিকার কী? জাহেদ পারভেজ : চুল পড়া প্রতিকারের ক্ষেত্রে প্রথম পরামর্শ হলো ট্রান্সফ্যাট মিশ্রিত ফাস্ট ফুড জাতীয় খাদ্য পরিহার করা, নিয়মিত ঘুম ও পরিমিত খাদ্যাভাস মেনে চলা। পাশাপাশি চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রসাধনী পণ্য ব্যবহার, বিউটি পার্লার বা জেন্টস পার্লারে চুলে হিট দেয়া ও স্ট্রেইট বা সোজা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা ও কিছু খাবার যেমন- দেশি বাদাম, চীনা বাদম, কাঁচা ছোলা, মিষ্টি কুমড়ার বিচি খেলে চুল পরা কমে যায়। যাযাদি: চুলের চিকিৎসার কোন দেশে কোন পদ্ধতি নিয়ে বেশি কাজ হচ্ছে? জাহেদ পারভেজ : ওষুধ ছাড়া নতুন উদ্ভাবনি পদ্ধতি যেমন- চুলের নতুন সেল জন্মাতে পিআরপি (পস্নাটিলেট রিচ পস্নাজমা) থেরাপি নিয়েই বেশি কাজ হচ্ছে। যেটি মানুষের মাথার চামড়ার নিচের রক্তের গ্রোথ ফ্যাক্টরে সারের মতো কাজ করায় নতুন সেল তৈরি হয় এবং নিয়মিতভাবে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই চুলের গোড়া মোটা ও শক্ত করে। যাযাদি: দেশে চুলের চিকিৎসার বর্তমান চিত্র কেমন? জাহেদ পারভেজ : উন্নত বিশ্বসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রাইকোলজি বা চুল বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৫ থেকে ৬ জন ট্রাইকোলজিস্ট বা চুল বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। এর বাইরে ত্বক বিশেষজ্ঞরা চুলের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের চিকিৎসা শিক্ষা সিলেবাসে (এমবিবিএস ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন) এ বিষয়টা খুবই স্বল্প। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত প্রতিটা সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ট্রাইকোলজি বিভাগ খোলা। যেখানে রোগীরা চুলের প্রাথমিক সেবাসহ স্বল্প খরচে চুল প্রতিস্থাপন ও থেরাপির মতো চিকিৎসা নিতে পারবেন।