ইউরিক এসিড ঠেকানোর উপায়

প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আমাদের শরীরে কোষের মধ্যে ডিএনএ আছে। ডিএনএর মধ্যে আবার পিউরিন নিউক্লিওটাইড থাকে। আবার যে খাদ্যদ্রব্য আমরা খাই, তার থেকেও পিউরিন পাওয়া যায়। এই কোষের মধ্যে থাকা পিউরিনের ভাঙনের ফলে শেষ উৎপাদন বা অ্যান্ড প্রোডাক্ট হিসেবে ইউরিক এসিড তৈরি হয়। এই ইউরিক এসিড রক্তে চলে যায় এবং কিডনির মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। ইউরিক এসিড থেকে শরীরে কী কী সমস্যা তৈরি হয় আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই ইউরিক এসিড থাকে, তবে সেটা একটা স্বাভাবিক পরিমাণে। অস্বাভাবিক ব্যাপার তখন হয়, যদি কিডনি থেকে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড বেরতে না পারে অথবা দেহে বেশি পরিমাণে ইউরিক এসিড তৈরি শুরু হয়। তখন শুরু সমস্যার। হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন অস্থি সন্ধি বা জয়েন্টে ইউরিক এসিড জমা হতে শুরু করে। তখন অস্থি সন্ধি লাল হয়ে ফুলে যায়, ব্যথা-যন্ত্রণা শুরু হয়। ফলে আক্রান্ত রোগীর হাঁটতে সমস্যা হতে পারে। ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ শৈশব ও কৈশোরে রক্তে ইউরিক এসিড বেশি তৈরি হলে, কিডনি থেকে সেটা সম্পূর্ণ নিষ্কাশিত হয় না। আবার থায়াজাইডের মতো কিছু কিছু ওষুধ প্রয়োগের ফলেও কিডনি থেকে ইউরিক এসিড বের হওয়াটা আটকে যায়। জিনগত সমস্যার কারণে ছোট বাচ্চাদের অতিরিক্ত ইউরিক এসিড তৈরিও হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে ইউরিক এসিড বাড়তে পারে। খাদ্য থেকেও কি বাড়তে পারে শরীরে ইউরিক এসিডের মাত্রা হঁ্যা, বাড়তে পারে। সচরাচর কিছু সবজি, ডাল খেলে ইউরিক এসিড বাড়ে এমন বলা হলেও জেনে রাখা দরকার বেশ কিছু প্রাণিজ খাদ্য থেকে কিন্তু অনেক বেশি মাত্রায় ইউরিক এসিড শরীরে জমা হতে পারে। শহরাঞ্চলে পাঁঠার মাংস, মেটে, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের ডিম এবং অ্যালকোহল (মূলত বিয়ার) খাওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণে ইউরিক এসিড বেশি হতে দেখা যায়। অন্য কারণেও কি হতে পারে ইউরিক এসিড বৃদ্ধি? ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়াটাকে মেটাবলিক সিনড্রোমের অংশ বলা হয়। তাই উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল-ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ডায়াবেটিস থাকলে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তার উপরে যদি নিকট আত্মীয়দের কারও এই সমস্যা বা কিডনি স্টোন, গাউটের সমস্যা থাকে, তাহলে সেই রোগীর ইউরিক এসিডজনিত সমস্যা অধিক মাত্রায় হতে দেখা যায়। আবার জীবন শৈলী সংক্রান্ত সমস্যা থেকে ইউরিক এসিডের আশঙ্কা থাকে। সে জন্য লিপিড প্রোফাইল হাই থাকলে ইউরিক এসিড টেস্ট করে বহু ক্ষেত্রে ইউরিক এসিডও বেশি পাওয়া যায়। যদি কারও ক্ষেত্রে রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের হার বেশি থাকলেও ইউরিক এসিডের পরিমাণ কম থাকে, তাহলেও ১/২ বছর অন্তর ইউরিক এসিডের মাত্রা পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয়। ইউরিক এসিড বেড়েছে কিনা জানতে কী কী পরীক্ষা করা হয় রক্তে ইউরিক এসিড কতটা রয়েছে জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এর জন্য ১২ ঘণ্টা খালি পেটে পরীক্ষা হয়। আবার স্টোন থাকলেও ইউরিক এসিডের পরিমাণ রক্তে সেই পরিমাণে বেশি না থাকলে, ২৪ ঘণ্টা ইউরিনে ইউরিক এসিড কতটা বেরচ্ছে সেটা পরীক্ষা করা হয়। বয়সের সঙ্গে ইউরিক এসিডের পরিমাণ অল্প হলেও ক্রমশ বাড়ে। তবে ছোটদেরও যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ছোটদের কিছু জন্মগত ত্রম্নটির কারণে ইউরিক এসিড, কিডনি স্টোনের সমস্যা হলে তখন জেনেটিক টেস্টিং করা হয়, সেটা শিশু বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। আবার প্রস্রাব আটকে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া বা জ্বালা অনুভূত হওয়া জাতীয় উপসর্গ হলে ইউটিআই বা প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়েছে কিনা, দেখা হয়। তাছাড়া রোগীর আগে কিডনি স্টোন ছিল কিনা জেনে নেয়া হয় এবং দেখা হয় রোগীর বস্নাডারে বা ইউরেটারে স্টোন হয়েছে কিনা। সেই মতো এক্স-রে, আলট্রাসোনোগ্রাম বা সিটি স্ক্যান করে সেগুলো দেখে নেয়া হয়। ইউরিক এসিড থেকে কী কী সমস্যা হতে পারে ১. ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যাকিউট ইউরিক এসিড আর্থ্রাইটিস হতে পারে। যাকে গাউট বলা হয়। এতে বুড়ো আঙুলের গোড়া লাল হয়ে ফুলে যায়, প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। এমনকি জ্বর এসে যেতে পারে। হাঁটু, গোড়ালি এবং পায়ের ছোট অস্থিসন্ধি, হাত, কনুই থেকে শুরু করে কবজি, আঙুলের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হতে পারে। চাপ পড়লেই ব্যথা বেড়ে যায়। তাই এই সময় বরফ সেঁক এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে বলা হয় ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি। ২. এ ছাড়াও ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি হতে পারে। এতে ইউরিক এসিড ক্রিস্টালের মতো হয়ে কিডনিতে জমে গিয়ে ইউরিয়া-ক্রিয়েটিনিন বাড়িয়ে দেয়। এর আবার দুটি ধরন। ক্রনিক ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি এবং অ্যাকিউট ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি। ৩. অ্যাকিউট ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি সাধারণত বস্নাড ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। তখন সেক্ষেত্রে প্রস্রাবের গতি এবং কিডনির সুস্থতা ঠিক রাখতে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরুর আগে ইউরিক এসিডের পরীক্ষা করে ইউরিক এসিডের মাত্রা কমিয়ে রাখার ওষুধ (অ্যালোপিউরিনল জাতীয়) দেয়া হয়। এর সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে ইনট্রাভেনাস ফ্লুইড দেয়া হয়। ৪. ইউরিক এসিড থেকে এ ছাড়া কিডনিতে স্টোনও হতে পারে। এটা ইউরেটার বা বস্নাডারে নেমে এসে প্রস্রাবের গতিরোধ, রক্তক্ষরণ করতে পারে। ইউরিক এসিড বাড়লে উপসর্গ থাকবেই, এমনটা কি সবক্ষেত্রে হয় না, আশ্চর্যজনক হলেও সব সময়ে যে উপসর্গ থাকবেই, এমনটা নয়। নিয়মিত চেক-আপে ইউরিক এসিড বেশি পাওয়া গেলেও এমনও হয় রোগীর জয়েন্টে ব্যথা, স্টোন নেই- অর্থাৎ কোনও উপসর্গ নেই। তখন একে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হাইপার ইউরিসিমিয়া বলা হয়। তখন অ্যালোপিউরিনল ইত্যাদি ওষুধ শুরু করা হয় না। রোগীর লিপিড প্রোফাইল এবং রক্তে সুগার কত জানতে হয়। এমনকী তার ক্যান্সার হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য সব ধরনের পরীক্ষা করতে হবে। রোগীর জীবনধারা কেমন, বাইরের জাঙ্ক খাবার, অ্যালকোহল, বিয়ার, রেড মিট বেশি খাচ্ছেন কি না্ত সব দেখতে হয়। রক্তে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৭ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬-সাড়ে ৬ থাকতে হবে। কিন্তু যার আগে গাউট বা কিডনি স্টোন হয়েছে তেমন ক্ষেত্রে ৬-এর মধ্যে থাকতে হবে এবং এর সামান্য উপরে গেলেই চিকিৎসা শুরু করা দরকার। আবার যারা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক গ্রম্নপে পড়ছেন, তাদের এই মাত্রা ৮ বা অধিক হলে তারপর চিকিৎসা করা যেতে পারে। একে কি তাহলে জিনগত রোগ বলা যায় না, ইউরিক এসিডকে ঠিক জিনগত রোগ বলা যায় না। কারণ জিনগত কারণের সঙ্গে জীবনধারার কারণেও এটা হতে পারে। তাই বাবা-মায়ের থাকলেই যে সন্তানের ইউরিক এসিড বাড়বে, এমন নয়। আবার এক পরিবারে ভাই-বোনের মধ্যে স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য সমস্যা থাকলে কার গাউট বা কিডনি স্টোন হবে, নাকি হবে না্তসেটা আগাম বলা যায় না। বরং বেহিসেবি জীবনধারা, নিয়মিত জাঙ্ক ফুড, রেড মিট, অ্যালকোহল সেবন থেকে এই সমস্যা হতেই পারে। টমেটো খেলে ইউরিক এসিড নাকি বাড়ে? তাহলে ইউরিক এসিডের ডায়েট চার্ট কেমন হবে টমেটো এমনিতে খুবই পুষ্টিকর একটি সবজি। এর নানা গুণ আছে। তবে এটা সত্যি যে, এর ফলে ইউরিক এসিড সামান্য হলেও বাড়ে, তাই বীজ বাদ দিয়ে টমেটোর শাঁসটুকু খান। এ ছাড়া পালং শাক, মসুর ডাল, সয়াবিন সবেতেই উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন থাকায় কম খেতে বলা হয়। তবে মনে রাখবেন যাবতীয় এই খাদ্য, সবজি বাদ দিয়েও ইউরিক এসিড হয়তো কমতে পারে মাত্র ০.৫। ফলে নজর দিতে হবে জীবনধারায়। শুধু পালং শাক, মসুর ডাল বাদ দেয়াটাই শেষ কথা নয়। কী খাব আর কী বাদ দেব, ভেবেই রোগী চিন্তায় রক্তচাপ বাড়িয়ে ফেলেন। য় সুস্বাস্থ্য ডেস্ক