আংটি

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শশধর চন্দ্র রায়
আকাশ ও অবন্তীর সংসারে দুই কন্যা। হিতৈষী ও লাবণ্য। আকাশ যেন অবন্তীর কাছে সবচেয়ে যোগ্য মানুষ। একটু ভাবুক প্রকৃতির। তিনি গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন। লেখার ফঁাকে ফঁাকে মেয়েদের লেখাপড়ার খেঁাজ নেন। হিতৈষী ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। আর লাবণ্য দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে বিধায় স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য লাবণ্যের সঙ্গে থাকতে হয় অবন্তীকে। তাদের পরীক্ষার ফল ভালো হলে কৃতিত্ব তার, খারাপ হলেও দুনার্ম যেন তার। দিন পঁাচেক পরে অবন্তীর বড় ভাই রঞ্জিত রায়ের নাতির মুখে ভাত অনুষ্ঠান। রঞ্জিত রায় একজন শিক্ষিত মানুষ। তিনি সচেতন অভিভাবকও বটে। দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক তিনি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বাধ্যগত কারণেই বলা চলে দুই বছর আগে ছোট মেয়ে অনামিকার বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে বণার্লী রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওগ্রাফিতে অনাসর্ দ্বিতীয় বষের্ পড়ছে। অনামিকার প্রথম পুত্র অজয়ের অন্নপ্রাশন। অনুষ্ঠানে তো যেতেই হবে। হাজার হলেও জামাইয়ের বাড়িতে অনুষ্ঠান। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী। অবন্তী ও আকাশ অনুষ্ঠানে যাবার কথা ভাবছে। কী উপহার দেয়া যায়? ভালো একটা কিছু তো দিতে হবে। উপহার হিসেবে আংটি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আকাশ। কিন্তু অবন্তী আংটি না দিয়ে অন্য ভালো উপহার দিতে চায়। আকাশ আংটি দিতে নাছোড়বান্দা হলে অবন্তী তাদের বিয়ের পূবের্কার কথা মনে করে দিয়ে বলে, ‘মনে নেই তোমার, রংপুর শিরিন পাকের্ তুমি আমাকে ভালোবাসার নিদশর্নস্বরূপ একটি আংটি উপহার দিয়েছিলে।’ ‘হ্যঁা, তা মনে আছে। তাতে কি হয়েছে?’ Ñ কেন ভুলে গেছ? সেই আংটিটি তারপর কীভাবে আমার হস্তচ্যুত হয়েছিল?’ Ñ না, ভুলিনি। শেষ কথা, আমি আংটি উপহার দেয়ার পক্ষে নই। প্রেমিক আকাশের দেয়া আংটিটির কথা আজও ভুলতে পারেনি অবন্তী। ভালোবেসে বিয়ে করেছে ঠিকই, কিন্তু আংটিটি তার জীবনের স্মৃতিপটে সুখের ক্ষত হয়ে আছে। অবন্তীর বাবা প্রফুল্ল রায় কাউনিয়া উপজেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তার জমি-জমাও প্রচুর। চার ছেলে ও পঁাচ মেয়ের মধ্যে বড় দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় ছেলে স্বপন রায়ের বিয়ে হবার মাত্র দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। মেজোদা স্বপনের বিয়েতে খুব আনন্দ করেছে অবন্তী। মেজো বৌদি প্রমিলার সাথে তার মধুর সম্পকর্। সময় পেলে দু’জনে বসে একসাথে গল্প-গুজব করে। প্রমিলাও অবন্তীকে খুব স্নেহ করে। কিন্তু বিধি বাম। স্বপন-প্রমিলার সাথে অবন্তীর এই মধুর সম্পকর্ বেশিদিন টেকেনি। বিয়ের তিন মাস অতিক্রান্ত না হতেই ঘটনার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রমিলা তার বিয়েতে দান পাওয়া আংটিটি হারিয়ে ফেলে। বাথরুমে হাত থেকে আংটিটি খুলে কোনো এক জায়গায় রেখে স্নান করছিল সে। স্নান শেষে আংটি নেবার কথা তার মনে ছিল না। ফলে বাড়িতে কাজের লোকসহ পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় কে বা কারা আংটিটি নিয়েছে তার হদিস মেলেনি। রান্নাঘরে ভাত খাচ্ছিল অবন্তী। হাতে ছিল প্রেমিকের দেয়া ভালোবাসার আংটি। মেজোদাও সেখানে ভাত খেতে আসে। হঠাৎ স্বপনের চোখ যায় আদরের বোন অবন্তীর বাম হাতে পরিহিত আংটিটির দিকে। ভাবে, বোন আবার আংটি পেল কোথায়? অবন্তীর হাতে স্বপন এর আগে কোনো আংটি দেখেনি। প্রমিলা নিজ ঘরে বিছানায় শুয়ে পেপার পড়ছিল। স্বপন খাওয়া শেষ করে ঘরে ফিরে প্রমিলাকে বলে, ‘শুনছ, অবন্তীর হাতে আমি একটি সোনার আংটি দেখলাম। আংটিটি তোমার হারিয়ে যাওয়া আংটিটির মতো দেখতে।’ Ñ তাই না কি! সে আংটি পেল কোথায়? Ñ যাও, তাকে বলোÑ আংটি কোথায় পেয়েছে? সন্ধ্যার সময় অবন্তী পড়ার ঘরে বই পড়ছিল। এ সময় মেজো বৌদির আগমন তার কাছে হেঁাচট খাওয়ার মতো ঠেকল। Ñ অবন্তী, পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে? স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অবন্তী বলে, ‘প্রস্তুতি মোটামুটি ভালো। আপনার আশীবার্দ পেলে পরীক্ষা ভালোই হবে আশা করি।’ প্রমিলা বঁাকা চোখে অবন্তীর বাম হাতের দিকে তাকায়। সে দেখে যে, তার হারিয়ে যাওয়া আংটিটির মতোই যেন একটি সোনার আংটি অবন্তীর হাতের শোভাবধর্ন করেছে। Ñ তোমার হাতে একটি সোনার আংটি দেখছি। Ñ হ্যঁা, বৌদি। এটা মাধব স্বণর্কারের দোকানে বানিয়ে নিয়েছি। ‘আচ্ছা’ বলে প্রমিলা সেখান থেকে ক্ষিপ্রগতিতে বের হয়ে যায়। প্রমিলা রাতে ঘুমার পূবের্ স্বপনকে বিস্তর খুলে বলে। পরদিন সকালে মেজোদা বোন অবন্তীকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে বলে, ‘বোন, তোমার আইএ ফাইনাল পরীক্ষা কবে শুরু হবে?’ - আগামী মাসের দুই তারিখ থেকে। - তোমার হাতের আংটিটি তো ভালোই। - হ্যঁা, দাদা। চার আনা ওজনের আংটি। - দেখি তো আংটিটি। অবন্তী সহজ-সরল মনে মেজোদাকে আংটিটি দেয়। - ঠিক আছে। এটা এখন আমার কাছে থাকুক, বিকেলে তোমাকে ফেরত দেব। স্বপনের মাথায় ঘুরছিল অন্যকিছু। দুই ঘণ্টা পর আলসিয়া বাজারে মাধব স্বণর্কারের দোকানে আংটিটির বিষয়ে যাচাই করতে যায় সে। আসলে কি অবন্তী মাধবের দোকান হতে এটি নিয়েছে। মাধবকে স্বপন আংটিটি দেখায়। মাধব বলে, ‘এ আংটিটি আমি তৈরি করিনি। আমি অবন্তীকে দুই আনার আংটি তৈরি করে দিয়েছি।’ শিরিন পাকের্ যেদিন আকাশ সোনার আংটি অবন্তীর হাতে পরিয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেদিনেই অবন্তী মাধবের দোকানে তৈরিকৃত আংটিটি আকাশের হাতে পরিয়ে দিয়েছিল। দু’জনের মাঝে সেদিন যে ‘আংটি পবর্’ সম্পন্ন হয়েছিল তা-ই পরবতীের্ত নতুন কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে স্বপন নিগূঢ় মনে ভাবতে থাকে। ভাবে, প্রমিলার হারানো আংটিটি ছিল চার আনা ওজনের। আবার অবন্তীর হাতে পাওয়া আংটিটিও চার আনা ওজনের। তাহলে কি তার বোন অবন্তী, স্ত্রী প্রমিলার হারানো আংটিটি নিয়েছে, যা তাদের কাছে গোপন করেছে। রাগে টইটুম্বুর হয়ে আছে স্বপন। অবন্তীকে সামনে পেলে কী বলবে তা ভাবতে পারছে না সে। বাড়ি ফিরে অবন্তীকে বলে, ‘তুমি আমাকে ও তোমার মেজো বৌদিকে আংটির বিষয়ে মিথ্যাচার করছ কেন?’ অবন্তী হতভম্ব হয়ে যায়। কী করে দাদাকে বলবেÑ আকাশ শিরিন পাকের্ তাকে আংটিটি দিয়েছিল। আকাশের সাথে অবন্তীর প্রেম ছিলÑ এ কথা পরিবারের সবাই জানত। আজ আর কোনো কথা লুকাবে না সে। Ñ দাদা, আংটিটি আকাশ আমাকে দিয়েছে। Ñ আকাশ! না না, আকাশ আংটি দিতেই পারে না। অবন্তীর কথা বিশ্বাস করে না স্বপন। আর তাই বোনকে আংটিটি কখনোই ফেরত দেয়নি সে। আজও আংটিটি প্রমিলার হাতের শোভাবধর্ন করে রেখেছে। প্রেমিকের দেয়া ভালোবাসার আংটি এভাবে অন্যের হাতে দিনের পর দিন শোভা পেতে দেখেছে অবন্তী। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, নিজের সম্পত্তি হলেও আজ তা অন্যের সম্পত্তি হয়ে রইল। আংটির কারণেই সকলের কাছে সে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত হয়ে রইল। বিয়ের পনেরো বছর পর স্বামীর সংসারে আজ অবন্তী ভালোই আছে। কিন্তু আংটিটির কথা এখনও তার মনে ভাবনার উদ্রেক করে। অবন্তী আজ কিছুতেই আকাশকে আর আংটি উপহার দিতে দেবে না অজয়ের অন্নপ্রাশনে। হায়রে আংটি, হায়রে ভালোবাসার উপহার! সদস্য জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম লালমনিরহাট