দাদন

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

কবির কাঞ্চন
রোমানের জন্মের আগে বিল্লাল সওদাগরের সংসারে সবই ছিল। রোমানের বাবা, বিল্লালের সওদাগরের ভ‚ঞার হাটে বিশাল মুদির দোকান ছিল। চাষের কিছু জমিও ছিল। এলাকার কেউ কোনো বিপদে পড়লে অমনি তিনি তাদের উপকার করতে ঝঁাপিয়ে পড়তেন। হাটের অন্যসব দোকানে যেখানে কাস্টমার থাকত না, সেখানে তার দোকানে কাস্টমারের ভিড় থাকত। সবকিছু খুব ভালোভাবেই চলছিল। হঠাৎ কেউ তার মাথায় নদীতে নৌকা নামানোর বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিল। সেই থেকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়েও তার মাথা থেকে নৌকার ভ‚ত নামানো গেল না। নদীতে নৌকা নামানোর বিষয়ে পরিবারের কারো সমথর্ন ছিল না। এ নিয়ে বিল্লাল সওদাগরের বাবা তো এক সপ্তাহ পযর্ন্ত তার সঙ্গে কথাই বলেননি। পরিবারের সব সদস্যের একটাই কথা ছিল। দোকানের ব্যবসা তো ভালোই চলছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু বিল্লাল সওদাগর ছিলেন নাছোড়বান্দা। মুখে যা বলবেন বাস্তবে তা করেই ছাড়বেন। নৌকা তৈরির জন্য দোকানের পুঁজিতে হাত দিলেন না তিনি। যেটুকু জমি আছে তাতে ভালোমতো চাষ করা হয় না। শুধু শুধু পড়ে আছে। বিকেল হলে সেখানে গ্রামের ছোট-বড় ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। শহরের আধুনিকতার ছেঁায়া ধীরে ধীরে গ্রামগঞ্জেও পেঁৗছে গেছে। এখন আর মাঠের পর মাঠ পড়ে নেই। খেলাধুলার জন্য অনাবাদি জমিগুলোই ওরা বেছে নেয়। বিল্লাল সওদাগরের জমিতে ছেলেমেয়েরা নিভের্য় খেলতে পারে। তিনি কখনও খেলতে বারণ তো করেন না। মাঝে মধ্যে একটু সময় পেলে খেলার দশর্ক হতে ভালোবাসেন; কিন্তু কি আর করার! নৌকা তৈরিতে যে অনেক টাকা লাগবে। তাই মনে পাথর চাপা দিয়ে তিনি সেই জমিটুকু বিক্রি করে দিলেন। নৌকা তৈরির সব সারঞ্জাম আনা হলো। কয়েকজন দক্ষ মিস্ত্রিও এলো। শুরু হলো নৌকা তৈরির কাজ। মাত্র এক মাসের মধ্যে দুটি নৌকা নদীতে নামবার উপযোগী হলো। বিল্লাল সওদাগর পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে মহাধুমধামে নদীতে দুটি নৌকা নামালেন। মাছ ধরার জন্য অগ্রিম দাদন দিয়ে দশজন জেলে নিয়োগ দিলেন। জালে প্রথম প্রথম বেশ মাছ লেগেছিল। এ নিয়ে তার সে কী উল্লাস! দোকানে কমর্চারী রেখে প্রতিদিন তিনি নদীর ঘাটে গিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু তার এই উল্লাস বেশিদিন টিকল না। সবার জালে প্রচুর মাছ লাগে। শুধু তার জালে মাছ লাগে না। যে মাছ লাগে তা দিয়ে জেলেদের খরচ হয় না। শুধু লোকসান হচ্ছে। আবার দোকানের দিকে মনোযোগ দিতে রোমানের দাদাসহ পরিবারের সবাই তাকে অনেক করে বোঝালো। কিন্তু তার একই কথা। আজ লোকসান হচ্ছে তো কাল লাভ হবে। দেখতে দেখতে তার দোকানেও লোকসান শুরু হয়ে গেল। দু’দিকের লোকসানে আর টিকতে পারছিলেন না তিনি। এরই মধ্যে বিল্লাল সওদাগর অনেক ধারদেনা করে ফেলেছেন। পাওনাদারদের জ্বালাতনে প্রায় পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। মাঝে মধ্যে বাড়ি আসতেন। খবর পেয়ে পাওনাদাররা বাড়ি এসে সবার সামনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করত। বিল্লাল সওদাগর তা মুখ বুঝে সহ্য করতেন। শেষে পাওনাদারদের চাপে টিকতে না পেরে দুটি নৌকাই বিক্রি করে দিলেন। এরপর আবার দোকানে বসতে শুরু করলেন। কিন্তু দোকানে তেমন মালামাল না থাকায় কাস্টমার খুব কম আসতো। নিয়তির নিমর্ম পরিহাসে বিল্লাল সওদাগর রাতের অঁাধারে নীরবে কেঁদেছেন। শেষমেশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বেকার বসে থাকতে লাগলেন। তার সঙ্গে পরিবারের সবার মনও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতে একরাতে তার মুখে হাসি দেখে পরিবারের সবার মনে আবার স্বস্তি ফিরে আসে। বিল্লাল সওদাগর সবাইকে কাছে ডেকে বললেন, Ñ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর অলসভাবে ঘরে বসে থাকব না। আমি ব্রিকফিল্ডের কাজে যাব। শেকু মাঝির কাছ থেকে আমি দশ হাজার টাকা দাদন নিয়েছি। আগামী সপ্তাহে তাদের সঙ্গে আমি কাজে যাব। বিল্লাল সওদাগরের বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, Ñ তুই কি এই কাজ করতে পারবি, বাবা? Ñ আমাকে পারতেই হবে, বাবা। এই কথা বলে হাউমাউ করে কঁাদতে লাগলেন বিল্লাল সওদাগর। ঘরের সবাই তার সঙ্গে অঝরে কঁাদতে থাকে। বিল্লাল সওদাগর সবার কান্না থামিয়ে বললেন, - আর কোন কান্না নয়। আমি যে হাতে সারাজীবন মানুষকে দিয়ে এসেছি, সে হাতে কীভাবে চাইতে পারি! তাছাড়া আমার রোমানও বড় হচ্ছে। ওর ভবিষ্যতের জন্য হলেও আমাকে আবার জীবন সংগ্রামে নামতে হবে। পরের সপ্তাহে বিল্লাল সওদাগর পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। শুরু হয় তার জীবনের কঠিন অধ্যায়। সারাদিন রোদে পুড়ে বিরামহীনভাবে কাজ করতে লাগলেন। এতো কষ্টের মাঝেও তিনি কাজে ফঁাকি দিতে চাইতেন না। তার ওপর মাঝিসহ অনেকেই তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করত। একসময় এই লোকটার কাছ থেকে তারা সহায়তা পেয়েছে। আজ ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে তাকে এই কাজে আসতে হয়েছে। একটানা চারমাস ব্রিকফিল্ডের কাজ হলো। কাজ শেষে কাজ বাবদ আরও ত্রিশ হাজার টাকা পেয়েছেন। বাড়ি এসে পাওনাদারদের কিছু টাকা পরিশোধ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করলেন। এখন আর তাকে পাওনাদারের জ্বালাতন সহ্য করতে হয় না। রোমানও নিয়মিতভাবে স্কুলে যাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জগতের সব কষ্ট ভুলে যান তিনি। একদিন সন্ধ্যায় রোমানকে কোলে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে সুখ-দুঃখের আলোচনা করছিলেন। এমন সময় বাবার চুলে আঙ্গুলের পরশ দিতে দিতে রোমান বলল, - বাবা, তোমার মাথায় এগুলো কী? বিল্লাল সওদাগর ইতস্তত করে বললেন, - ওসব কিছু না, বাবা। মাথার উঁচুনিচু অংশ। রোমান নিজের মাথায় হাতড়িয়ে দেখে অবাক হয়ে বলল, - কৈ আমার মাথায় তো তোমার মতো কোনো উঁচুনিচু অংশ নেই! ততক্ষণে বিল্লাল সওদাগরের মা দৌড়ে এসে ছেলের মাথায় হাতড়িয়ে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন। মাথার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফেঁাস্কা পড়ে গেছে। মাথার কোনো কোনো অংশের চুলও অসম্ভব হারে কমে গেছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে তিনি হাউমাউ করে কঁাদতে লাগলেন। পাশ থেকে বিল্লাল সওদাগরের বাবা বললেন, - এভাবে কঁাদছো কেন? আমার বিল্লালের কী হয়েছে? - আমার কলিজার টুকরার মাথাটা ধরে দেখো। পুরো মাথায় ফোস্কা পড়ে গেছে। মাথার অনেক জায়গায় চুলও উঠে গেছে। এমন কাজ আর করতে হবে না, বাবা। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকব। তবু তোকে এই কষ্টের কাজে আমি যেতে দেব না। বিল্লাল সওদাগর মাথানিচু করে নিশ্চুপ বসে রইলেন। পাশ থেকে তার বাবা আবার বললেন, - এত কষ্টের কথা কখনও তো বলিসনি, বাবা। - না বাবা, প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও পরে তা সয়ে গেছে। তোমরা বেশি চিন্তা করছ। সব ঠিক হয়ে যাবে। (চলবে...) সদস্য জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম চট্টগ্রাম