দাদন

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

কবির কাঞ্চন
(পূবর্ প্রকাশের পর) এভাবে মাসখানেক সময় কেটে গেল। হাতের টাকাও ফুরিয়ে গেছে। আবার ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ইলিশ মাছের মৌসুম চলে এসেছে। জব্বার মাঝির অধীনে অনেকে নাম দিয়ে দাদন নিচ্ছে। খবর পেয়ে বিল্লাল সওদাগরও দাদন নেবার চিন্তা করছেন। জব্বার মাঝি সুবিধার লোক নন। ইলিশ মাছের মৌসুম এলে তার তৎপরতা বেড়ে যায়। দেখে দেখে সমাজের অসহায় মানুষদের ন্যূনতম মজুরি ধরে দাদন দিয়ে থাকেন। এরপর সময়মতো বিভিন্ন নৌকায় তুলে দেন। পুরো মৌসুমে তাদের নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বেড়িবঁাধ এলাকায় জাল বুননের মধ্য দিয়ে তাদের অবসরে সময় কাটে। এরই মধ্যে কেউ কেউ কাজ থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু জব্বার মাঝির কাছ থেকে নিস্তার পায় না। তাদের থেকে হয় দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ নিয়ে নেবে। নয়তো জোর করে ধরে বেঁধে কাজে নিয়ে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে বিল্লাল সওদাগর একাকী দীঘর্ নিঃশ্বাস ছাড়েন। আর কোনো উপায় না দেখে বিল্লাল সওদাগরও দাদনের জন্য তার কাছে গেলেন। জব্বার মাঝি প্রথমে তাকে কাজে নিতে চাননি। এত কষ্টের কাজ পারবে না ভেবে নিতে চাইছিলেন না। শেষমেশ বিল্লাল সওদাগরের অনুরোধে রাজি হয়ে দাদন হিসেবে তাকে মাত্র পঁাচ হাজার টাকা দিলেন। শনিবার পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় উঠলেন। চট্টগ্রামে এসেই প্রচÐ ঠাÐার মধ্যে প্রতিদিন মাছ ধরার কাজে মোহনায় যেতে হয়। নদীতে প্রচুর মাছ পায় তারা। সারাদিন কঠোর খাটুনি করে মাছ ধরে তীরে এসে মহাজনের কাছে জমা দিতে হয়। নিজেদের খাওয়ার জন্য এক/দুইটা মাছ চেয়ে নিতে হয়। মহাজনের কাছে জমা দেয়ার আগে অন্যান্য খালাসিরা দু/চারটি মাছ লুকিয়ে রাখলেও বিল্লাল সওদাগর তা করেন না। তার নৌকার মাঝি তা লক্ষ্য করেন। এভাবে মাস দুয়েক কেটে গেল। একদিন নদীতে যাবার প্রস্তুতি চলছে। বিল্লাল সওদাগর একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের এক কোণে বসে কাতরাতে লাগলেন। মাঝি খবর পেয়ে এসে তাকে কিছু ওষুধপাতি কিনে দিয়ে রুমে রেখে নদীতে চলে যান। এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। দিনেদিনে তার অসুস্থতা আরও বাড়ছে। ওদিকে নিয়মিত নদীতে যাচ্ছে না বলে মহাজন। মাঝির ওপর চড়াও হচ্ছে। শেষমেশ অসুস্থ শরীরে তাকে মাছ ধরতে আসতে হয়। পরদিন তার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ দেখে মাঝি কিছু টাকা ও কয়েকটি মাছ দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বাবার হাতে মাছ দেখে রোমান খুব খুশি হয়। সে প্রাণ ভরে হাসে। ছেলের নিটোল হাসিতে বিল্লাল সওদাগরের রুগ্ণ দেহের সব কষ্ট মন থেকে মুহূতের্ সরে যায়। পরিবারের সঙ্গে কয়েকদিন কাটানোর পর একটু সুস্থতার দিকে এলে জব্বার মাঝি তাকে আবার কাজে ফিরে যাবার তাগাদা দেয়। বিল্লাল সওদাগর কিছু টাকা চাইলে জব্বার মাঝি উচ্চবাক্যে বললেন, - কাজ করেছ কয়দিন? আবার টাকা চাও। ওখানে গিয়ে কাজের সময় অসুস্থ হয়ে রুমে শুয়েছিলে। আমার কাছে সব খবর আছে। মহাজন বলেছেন, তোমরা নাকি ঠিকমতো মাছও জমা দিতে না। মাছ লুকিয়ে চুরি করে বিক্রি করতে। সবাই চোরের গোষ্ঠী। তাছাড়া তোমার খাওয়া খরচ আর চিকিৎসা মিলে যা খরচ হয়েছে তাতে তুমি আরও দেনা আছ। বিল্লাল সওদাগর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, - আপনি এসব কি কথা বলছেন! আমি তো কোনোদিন কাজে ফঁাকি দিইনি। অসুস্থ হবার আগ পযর্ন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। একটা একটা করে মাছ মহাজনের লোকজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আপনি আমাকে চোর বলছেন! - ঠিক আছে, আর ন্যাকামো করতে হবে না। আগামীকাল রেডি থাকবে। কালই কাজে যেতে হবে, বুঝলে? - জ্বি, কিন্তু আমি তো এখনও ...। জব্বার মাঝি ধমকের সুরে বললেন, - তোমার আর কোনো কথা শুনতে চাই না। কালকে যেন বেঁধে নিতে না হয়। এই কথা বলে জব্বার মাঝি চলে যায়। পরদিন সকালে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিল্লাল সওদাগর ঘর থেকে বের হন। কিছুপথ যেয়ে আবার ঘরে ফিরে আসেন। রোমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে দু’চোখের জল ছেড়ে দেন। রোমানের মা কাছে এসে অঁাচল দিয়ে স্বামীর চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, - তোমার কি হয়েছে? এভাবে কঁাদছো কেন? - আজ আমার কেমন যেন লাগছে, সাথী। মনটা খুব ভার ভার লাগছে। - তাহলে আজ কাজে না গেলে হয় না? - না, ও কথা বলো না। এখন জালে ভালো মাছ ধরা পড়ছে। না গেলে মহাজনের লোকরা বাড়ি এসে ধরে নিয়ে যাবে। তাতে মান-সম্মান যা আছে তাও হারাতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি। রোমানকে দেখে রেখো। - আচ্ছা। এরপর বিল্লাল সওদাগর চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। চট্টগ্রামে এসে আবার নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে আরও কিছুদিন কেটে যায়। আজ সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিল্লাল সওদাগরের নৌকার মাঝি তার দলবল নিয়ে মাছ ধরতে নদীর দিকে ছুটছেন। পছন্দমতো স্থানে জাল ফেলে নৌকায় বসে আছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অঁাধার নামছে। সেই সাথে আকাশেও বেশ মেঘ জমেছে। সময় যতোই গড়াচ্ছে ততোই আকাশে মেঘের গজর্ন বাড়ছে। আকাশে হঠাৎ হঠাৎ বিজলী চমকাচ্ছে। উত্তাল ঢেউয়ে তাদের নৌকা বাতাসের সাথে এদিক-ওদিক দুলছে। তারা তাড়াতাড়ি জাল গোছাতে লাগলো। অন্যদিনের তুলনায় আজ জালে প্রচুর মাছ লেগেছে। মাঝি সবাইকে সাহস দিতে গিয়ে বললেন, - একটু পর বাতাস কমে যাবে। তোমরা নৌকায় ভালোভাবে মাছ তোল। মাঝির নিদেের্শ সবাই আবার মাছ তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তখনও নৌকার ইঞ্জিন রুমে বসে বসে চিৎকার করে কঁাদছে কালুর বাপ। খুব ভীতু স্বভাবের লোক। একটু ঢেউ দেখলে ভয় পেয়ে যায়। বিল্লাল সওদাগর মাঝির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার কাছে এসে সান্ত¡না দিতে লাগলেন। বিল্লাল সওদাগরের কথা শোনে কালুর বাপ তার কান্না থামিয়ে স্বাভাবিক হন। ওদিকে জাল সম্পূণর্রূপে নৌকায় তোলা হলো। মাছে নৌকা ভরে গেছে। বিল্লাল সওদাগর ইঞ্জিন রুম থেকে বের হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। আশপাশের ডিঙি নৌকাগুলোও দেখা যাচ্ছে না। ধেয়ে আসা ঢেউয়ের জলরাশিতে ভিজে একাকার হয়ে অন্যান্য খালাসিদের কাছে চলে আসেন। এবার তীরে ফেরার পালা। মাঝ দরিয়ায় হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে লাগল। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে সামনের পথ দেখা যাচ্ছে না। একবার নৌকা বেশ উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার খুব নিচে নেমে যাচ্ছে। একেকবার মনে হচ্ছে নৌকা তলিয়ে যাচ্ছে। সবাই ভয়ে আল্লাহ, রাসূলকে স্মরণ করে জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগল। হঠাৎ জোরে একটা শব্দ হলো। মাঝি টচর্লাইট মেরে সবাইকে লক্ষ্য করলেন। সবকিছু ঠিকমতো আছে। এবার ইঞ্জিন রুমের দিকে টচর্লাইট মারলেন। সেখানে কেউ নেই। এরপর পুরো নৌকা খেঁাজে কালুর বাপকে আর পাওয়া গেল না। সবাই ভয় পেয়ে গেল। আবার যাত্রা শুরু করল। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা সময় কেটে গেল। বাতাসের তাÐব যেন সময়ে সময়ে বাড়ছে। আবছা আলোয় দূর থেকে ঘাটের আলো চোখে পড়ছে। আশায় বুক বেঁধে সবাই জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগল। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তাদের নৌকাটি উল্টে যায়। সবাই যার যার প্রাণ বঁাচাতে নদীতে ঝঁাপিয়ে পড়ে। উত্তাল ঢেউ আর বাতাসের ‘শো শো’ শব্দে তাদের বঁাচার আতির্চৎকার কারোর কানে পেঁৗছছে না। বঁাচার আকুতিতে যে যার মতো সঁাতরাতে লাগল। রাতের অঁাধার কেটে যেতে না যেতে মেঘনা নদীক‚লের বাতাস স্বজন হারানো মানুষের গগনবিদারী আতর্নাদে ক্রমেই ভারি হয়ে উঠেছে। (শেষ)