বাংলা কাব্য সাহিত্যে শরৎকাল

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

রীমা আক্তার
নদীর তীরে কিংবা বনের প্রান্তরে নয়ন জুড়ানো কাশফুলের সামনে প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে পথ চলার ইচ্ছা নেই এমন বাঙালি প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা পাওয়া এ দেশে দুষ্কর। শরৎকালে কখনো কখনো বষর্ণ হয়, তবে বষার্র মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বাতার্ বয়ে আনে। শরতের সৌন্দযর্ বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়। ভাদ্র আশ্বিন এ দু’মাস শরৎ ঋতু। চযার্পদ থেকে শুরু করে আজকের কবির রচনায়ও শরৎকাল হাজির হয় তার রূপ-বৈচিত্র্য ও নান্দনিকতা নিয়ে। শরৎ নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলিতে আমরা পাইÑ এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর। বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত মহাকবি কালিদাসও শরৎ বন্দনায় ছিলেন অগ্রবতীর্। তিনি বলেন ‘প্রিয়তম আমার, ওই চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ মধ্যযুগের ধারাবাহিকতা শেষে আধুনিক যুগের কবিদের কবিতায় শরতের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশেষ রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও গানে শরতের বন্দনা লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎকে ঘিরে প্রচুর কবিতা ও গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করে গেছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ আজি কী তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শারদ প্রভাতে/হে মাতা বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোড়াতে। বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আমরা শরতের চিত্র দেখি যেভাবে। ‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?/নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!/অলকার পানে বলাকা দুটিছে মেঘ দূত মনমোহিয়া। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় শরতের যে চিত্র আমাদের বিমোহিত করে তাহলো ‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল/ আসিল ভাদ্র মাস,/বিরহী নারীর নয়নের জলে/ভিজিল বুকের বাস”। নাগরিক কবি শামসুর রাহমান শরৎ নিয়ে তার কবিতায় লেখেন “জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের খুশির জ্যোতিকনা”। কবি নিমের্লন্দু গুণের কাশফুলের কাব্যে শরৎ এসেছে সরাসরি। কোথাও কোনো ভনিতা নেই। কাশবনের নয়নাভিরাম দৃশ্যে কবি মুগ্ধ। কাশবনের ধারে কবি এক কাশকন্যাকে দেখতে পান। কালো খেঁাপায় গেঁাজা সাদা কাশফুলে কাশকন্যাকে শরতের রাণী মনে হয়েছে কবির কাছে। তাই কাশকন্যার ক্রীতদাস হতেও দ্বিধা নেই কবির। কবি বলেন ‘সবে তো এই বষার্ গেল/শরৎ এলো মাত্র,/এরই মধ্যে শুভ্র কাশে/ ভরলো তোমার গাত্র। ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের ঐ পাড়টায়/হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/ বঁাশবনের ঐ ধারটায়/আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে/ মাটির দিকে নুয়ে/ দেখি ভোরের বাতাসে কাশ/দুলছে মাটি ছুঁয়ে।/পুচ্ছ তোলা পাখির মতো/কাশবনে এক কন্যে,/তুলছে কাশের ময়ূর চ‚ড়া/কালো খেঁাপার জন্য।/প্রথম কবে ফুটেছে ফুল/সেই শুধু তা জানে/তাই তো সে তা সবার আগে/খেঁাপায় বেঁধে আনে।/ইচ্ছে করে ডেকে বলি/‘ওগো কাশের মেয়ে,/আজকে আমার চোখ জুড়ালো/ তোমার দেখা পেয়ে।/তোমার হাতে বন্দি আমার/ ভালোবাসার কাশ,/তাই তো আমি এই শরতে/তোমার ক্রীতদাস।’ শরতের শিউলি ঝরা ভোর আমাদের অন্তরজুড়ে স্নিগ্ধতার প্রলেপ বিছিয়ে দেয়। ক্ষণিকের অতিথি এই শরৎ। শরতের এ সময়টা শস্যপূণার্। ধানক্ষেত এ সময় ফল সম্ভাবনায় পরিপূণর্। শরৎ প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় যার আবেশে অতি সাধারণ মানুষ ও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়। শরৎ অবসাদগ্রস্ত মনেও নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। ঋতু পরিক্রমায় শরৎ আসবে শরৎ যাবে কিন্তু কবিচিত্তে রেখে যাবে তার সরব উপস্থিতি। বাংলাকাব্য সাহিত্য শরৎবিষয়ক প্রতিটি কবিতাই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। শরৎ বন্দনায় কবির পঙ্ক্তিমালায় শরতের রূপ-বৈচিত্র্য যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি শরৎ বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তাইতো রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় ‘শরতে আজ কোনো অতিথি এল প্রাণের দ্বারে, আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে’।