শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
অ নু গ ল্প

মেঘ ও মায়া

জুয়েল আশরাফ
  ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০

সকাল থেকে ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি। তার ওপর লোডশেডিং। বড় বিরক্তিকর। অনেকদিন এরকম হয় না, মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। নিশিকে দেখলাম উত্তেজিত হয়ে ঘরের মেঝেতে হাঁটছে। আমাদের কাউকেই হাসপাতালে থাকতে দিল না। সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। সেই কখন থেকে নিশি অস্থির আর বিচলিত হয়ে পায়চারি করছে! এর মধ্যে আমি বিনয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বললাম, দুপুর থেকে খাওনি। পিস্নজ খেয়ে নাও।

নিশি বলল, আম্মার খবর না পাওয়া পর্যন্ত খাব না।

আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। আমি ভালোভাবেই জানি, নিশি তার ডাক্তার-আম্মার কী পরিমাণ বাধক! বিয়ের প্রথমরাতেই নিশি বলেছে, আম্মার পছন্দ হয়েছে বলেই আপনার গায়ের রঙ বিশ্রী রকমের কালো জেনেও বিয়েতে রাজি হয়েছি। যদি একজন কানা খোঁড়া ছেলে ধরে এনে বলতেন এই ছেলেকে বিয়ে করতে হবে, তাই করতাম।

ছোটবেলা থেকে তার ডাক্তারি পোশাকের মধ্যে সারাক্ষণ পেঁচিয়ে থাকত বলে মাঝেমধ্যে তার ডাক্তার-আম্মা রাগ করে বলতেন, 'তোর মতন মা-পাগল মেয়ে কাউকে দেখিনি। রোগীরা কী ভাববে বল তো?' নিশি জানে, রোগীরা আর যা-ই ভাবুক, এটা নিশ্চয়ই ভাববে না সে ডাক্তার-আম্মার পালিত কন্যা।

\হতখন ছয় বছর বয়স নিশির। পৃথিবীতে একজন মামা ছাড়া আর কেউ নেই। একমাত্র মামা নিশিকে নিয়ে এলেন ডাক্তারের কাছে। স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে ডাক্তার ছোট্ট নিশিকে কোলে নিয়ে চুমু খেলেন। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে এলেন বাড়িতে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রতিরাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খাওয়া-পড়ার খবরাখবর নিতেন। যদিও দেখাশোনার জন্য বাড়িতে আরও অনেকেই ছিল। নিশির কোনো রকমের কষ্ট তিনি একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। তাকে কেউ যত্ন করছে দেখলে কী যে খুশি হতেন!

একবার আম্মা বললেন, তুই আমাকে মা নাকি আম্মা ডাকবি নিশি? নিশি বলল, তুমি তো ডাক্তার। তোমাকে ডাক্তার-আম্মা বলব। ডাক্তার-আম্মা সেই কথা শুনে কী হাসিটাই হাসলেন। নিশিকে বললেন পাগল মেয়ে। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেল। নিশি বড় হয়ে উঠল। বিয়েও হয়ে গেল।

\হকরোনা রোগী নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তার ডাক্তার আম্মা। মাঝে মাঝে রোগীদের সেবা দিয়ে অধিক রাতে বাসায় ফিরতেন। এখন তো নিজেই তিনি রোগী হয়ে আইসিওতে। রাত ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। কিন্তু কারোর ফোন এলো না। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল নিশি বারান্দায় চেয়ারে। সকালে এলো ফোনটা। আমি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন ভারী গলায় বলল, ডাক্তার ম্যাডাম কিছুক্ষণ আগে মারা গেলেন।

খবরটা খুব সাবধানে বলতে এসে দেখি নিশি জানালার বাইরে সকালে মেঘের আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কাছে এসে তার হাত ধরলাম। কী শীতল হাত! সে আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, সবাই জানে আমি তার পালিত কন্যা। কিন্তু ডাক্তার-আম্মা কখনো বুঝতে দেননি। জন্ম না দিলেও তিনি আমার মা। নিজের মেয়ের মতো আগলে আদরে রেখেছেন। জন্ম দেয়নি ঠিক, কিন্তু তিনি না থাকলে আমার কী যে হতো, ভাবতেই পারি না।

আমি নিশিকে আমার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিলাম। কেন জানি এই মেয়েটির প্রতি তীব্র মায়ায় আমার চোখ ভিজে উঠল। বাইরের আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে