অভিমানী

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ঊষার মাহমুদ
একসময় অনেক স্বপ্ন দেখতাম। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। কাক্সিক্ষত স্বপ্নের শেষ সিঁড়িতে দঁাড়িয়ে পৃথবীকে শোনাব স্বপ্ন ছেঁায়ার গল্প। এখন আর স্বপ্ন দেখি না; কারণ স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কোনো কিছুই এখন আমাকে আনন্দিত করতে পারে না। ভালো থাকবেন। হয়তো আর কখনোই কথা হবে না।’ এটাই ছিল ওর শেষ রিপ্লাই। এরপর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফেসবুকসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ওর খেঁাজে আমি পাগল হয়ে উঠলাম। যাদের সঙ্গে ওর ভালো সম্পকর্ ছিল আমি ঢাকা গিয়ে তাদের সবার সঙ্গে দেখা করেছি। কেউ বলতে পারে না, সে কোথায় আছে? কেমন আছে? যার প্রোফাইলটা একটু পরপর না দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না। এমন একটা মানুষের নিরুদ্দেশ নীরবতাতে আমি কী করে ভালো থাকি? ওর স্ট্যাটাসের প্রতিটা অক্ষরে যেন না পাওয়ার আক্ষেপ। ওর সঙ্গে আমার গত তিন বছর যাবৎ পরিচয়। ওর নাম সুমি, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। কখনো ফোনে কথা হয়নি। চ্যাটিং হয় রোজ। পরিচয়ের শুরু থেকে যতবার জিজ্ঞাসা করেছি, কখনো শুনতে পাইনি ও ভালো আছে। একটাই কথা- ভালো নেই। আমি ওর দুঃখী দুঃখী ভাবটার প্রেমে পড়ে গেছি। ও ভালো থাকে না কেন, এই কৌত‚হলটা আমাকে সব সময় তাড়া করে। ‘আপনি তো আমাকে এখনো বন্ধু ভাবতে পারেননি? ‘যদি বন্ধু না ভাবতাম তাহলে কী রাত জেগে আপনার সঙ্গে চ্যাটিং করতাম।’ ‘আপনি ভালো থাকেন না কেন? এই একটা প্রশ্ন হাজার বার করার পরও কোনো উত্তর পাইনি। ‘দেখুন, এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমি কখনোই দিতে পারব না।’ ‘আমি জানতে চাই আপনার অস্থিরতার কারণ? যদি না বলেন তাহলে আমি আর কখনো আপনার সঙ্গে কথা বলব না। এই কথাটা সেন্ড করে ফোনটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পেলাম একসঙ্গে অনেক ম্যাসেজ। ম্যাসেঞ্জারের ভেতরে ঢুকে পড়তে থাকি- ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন নাজমা নামের এক বান্ধবীর বিয়ে হয়। সেই থেকে শুরু হলো সহপাঠী মেয়েদের বিয়ে। আর আমি এটা সেটা গিফট নিয়ে ওদের বিয়ে খেতে থাকি। আমি অনেক চঞ্চল ও মিশুক প্রকৃতির ছিলাম, তাই ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই ভালো সম্পকর্ ছিল। অবশেষে আমরা তিনজন ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। এসএসসির মতো ইন্টারেও ভালো রেজাল্ট করলাম। আমাদের পাড়ায় তখন আমিই একমাত্র অবিবাহিত। সমবয়সী বন্ধুদের সবাই তখন দু-একটা সন্তানের মা। ওরা স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আমার স্বপ্নের হাতছানিতে স্বপ্নছেঁায়ার পথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পথিক। পৃথিবীতে সব বাবা-মাই সন্তানের ভালো চায়। আমার বাবা-মাও তার ঊধ্বের্ ছিলেন না। অনেক বড় ঘরের ছেলে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। মাসে অনেক টাকা রোজগার করে। এমন ছেলে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাননি। ছেলের বাবা-মাসহ ছেলেটা আমাকে দেখতে আসলেন। দেখে একটি হীরের আংটি পরিয়ে দিলেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আমাকে মোহিত করতে পারেনি। বারবার ইয়াকুব স্যারের কথাগুলো মনে ভাসতে লাগল। ইয়াকুব স্যার। আমাদের গ্রামের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমার মাথায় হাত রেখে স্যার বলেছিলেন, ‘মা’রে থেমে যাসনে যেন, তোকে অনেক দূরে যেতে হবে। তুই পারবি মা, তুই-ই পারবি আমাদের এই পাড়াগঁায়ের নাম উজ্জ্বল করতে।’ বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করার পর আমি সফল হলাম। বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর বেশকিছু দিন আব্বা-আম্মা আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ২. রেজাল্ট ভালো ছিল। কোনো পরীক্ষাতেই আমার রেজাল্ট খারাপ ছিল না। পাড়াগঁায়ে থেকে এসে ঢাকায় এক ভাসিির্টতে ভতির্ হলাম। একসময় বুঝতে পারলাম; সংসার চালিয়ে আমাদের ভাইবোনগুলোর পড়ার খরচা দিতে কষ্ট হতো। বাবা আমাদের তা বুঝতে দিতেন না। ঢাকায় এসে দেখলাম আমার মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েগুলো টিউশনি করে পড়ার খরচা চালাচ্ছে। আমিও টিউশনি করতে লাগলাম। বাবার কাছ থেকে আর টাকা আনতে হয় না। প্রেমের প্রস্তাব কয়েকটা পেয়ে গেলাম। আমি কাউকে পাত্তা দেইনি; কারণ আমাকে আমার স্বপ্নের শেষ সিঁড়ি অবধি পৌঁছতে হবে। না জানি প্রেমে পড়ে যাই। তাই কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বও পযর্ন্ত করিনি। ভালোবাসার মানুষটা যদি ছলনা করে সেটা সইতে পারব না আমি। পাড়াগঁায়ের মেয়ে আমি, কারো সঙ্গে প্রেম করলেও সেটা সাফল্যের মুখ দেখবে না। শুধু কল্পনার রং-তুলিতে হৃদয়ের পটে এঁকে গেছি অচেনা সেই মুখ, যাকে আল্লাহ শুধু আমার জন্য পাঠাবেন। অনাসর্ শেষ করে চাকরির জন্য এখানে-সেখানে অ্যাপ্লাই করতে থাকি। মাসে দু-একবার বাড়িতে যেতে হয়। বেশ কয়েক জায়গা থেকে আমাকে দেখতে আসে। বেশির ভাগই সৌদি, মালয়েশিয়া, দুবাইপ্রবাসী ছেলে। তাতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু যখন দেখি ওদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসিও না। মাস্টাসর্ করছি এমন একটা মেয়ে কী করে ওদের হাতে জীবনটা ছেড়ে দেই? আমি খুঁজছি সেই সুখ; যে সুখের হাতছানিতে ছিল আমার বিরামহীন ছুটে চলা। কিন্তু কোথায় সে সুখ? এখানে তো বিষণœতা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। ক্রমশই যেন মনের আনন্দগুলো বিষণœতার দখলে চলে যেতে লাগল। পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে আনন্দ দিতে পারে না। নিরাশার কশাঘাতে দিন থেকে দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলাম। কারো সঙ্গে কথা বলা, আড্ডা মারা, ঘুরে বেড়ানোÑ এসব কিছুই ভালো লাগে না। জীবন চলার পথে কী যেন হারিয়ে এসেছি; যা এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো আর কখনো ফিরে পাব না। ভালো থাকবেন। কাছে যেতে গিয়ে হয়ে গেলাম দূরত্বের শিরোনাম। কোথায় হারিয়ে গেলেন আমাকে না বলে? শুভ্রবলাকার মতো অভিমানী মন সে আমি বুঝতে পারিনি...। আমার তো খুব ইচ্ছা হয়; আপনার সব বিষণœতাকে বুকে পেতে নিতে। খুব করে ইচ্ছা হয়; আমার সবকিছু দিয়ে আপনাকে সহজ আর সুন্দর করে তুলি।