বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সবচেয়ে জরুরি অথচ অবহেলিত

ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা দুই কোটি ছুঁইছুঁই। এত মানুষের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট গণশৌচাগার রয়েছে ১০১টি। এসব শৌচাগার ইজারা দিয়ে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আয় বাড়লেও সেবার মানের দিকে কারও নজর নেই।
শামীম আহমেদ
  ১৭ মে ২০২২, ০০:০০

সেদিন অফিস শেষে এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর অফিসের সামনে গেলাম। আড্ডা শেষে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করলে অসহনীয় দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরতে বাধ্য হলাম। এ দৃশ্য শুধু কারওয়ান বাজার নয়, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি গলি ও ফুটপাতের। এ নিয়ে আমার বন্ধু বলছিল, ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন মানুষের সুবিধার্থে বিভিন্ন এলাকায় শৌচাগারের ব্যবস্থা করেছে। এখানে প্রস্রাব করলে ৫ ও মলত্যাগ করলে ১০ টাকা লাগে। তাই অনেক মানুষ টাকার কারণে এসব শৌচাগারে না গিয়ে রাস্তার কোণায় মলমূত্র ত্যাগ করছেন। তার কথা একবারে মিথ্যা নয়, তবে কিছু মানুষ বাধ্য হয়েও এ কাজটি করে থাকে।

বলছিলাম ঢাকার গণশৌচাগারের কথা। ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা দুই কোটি ছুঁইছুঁই। এত মানুষের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট গণশৌচাগার রয়েছে ১০১টি। এসব শৌচাগার ইজারা দিয়ে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আয় বাড়লেও সেবার মানের দিকে কারও নজর নেই।

অন্যদিকে ঢাকা শহরের ভাসমান ও পথচারীদের ব্যবহারের জন্য ৩৬ জায়গায় ৪৫টি ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার স্থাপন করে সিটি করপোরেশন। এ প্রকল্পটি শুরুতে সাড়া জাগালেও অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এসব মোবাইল টয়লেট। এছাড়াও ঢাকার বস্তিবাসীদের শৌচাগারের অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ এক জরিপে বলা হয়েছে, শহরে ২২ শতাংশের বেশি মানুষ ভাগাভাগি করে শৌচাগার ব্যবহার করছে।

ঘরের বাইরে গেলে গণশৌচাগারের সংকটের কারণে নানা সমস্যা পোহাতে হয়। বছর পাঁচেক আগে ফুটবল খেলা দেখতে আমার বাড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এ সময় একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টয়লেটে প্রাকৃতিক ডাকের সাড়া দিয়ে গিয়ে পড়লাম বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। কারণ সেখানে দরজার কোনো লগ ছিল না। প্রতিনিয়ত এ রকম অবস্থায় পড়তে হচ্ছে দেশের অগণিত শিক্ষার্থীদের।

কয়েকদিন আগে কথা হচ্ছিল এক স্কুল শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি জানান, সকালে কম পানি পান করে বিদ্যালয়ে আসেন, স্কুলে এসেও পানি পান করেন না। কারণ তাদের এখানে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। টয়লেট করতে গিয়ে যদি আবার বিপাকে পড়তে হয়। এই ভয়েই স্কুলের টয়লেটে যাও হয় না তার। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা টয়লেট না থাকার পাশাপাশি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশও তাকে সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করে। এটা শুধু তার বিদ্যালয়ের চিত্র নয়, সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ দৃশ্য। চিকিৎসকরা বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে সময়মতো টয়লেটে না যাওয়ার কারণে কিডনিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অথচ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরদারিতে আনতে হবে। এ কমিটি এসব খাতের জন্য পৃথক একটি সংরক্ষিত তহবিলের ব্যবস্থা করবে। টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ করবে। সংরক্ষিত তহবিল থেকে এ ব্যয় মেটান যাবে।

পরিপত্রে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখা, টয়লেটে ঢাকনাযুক্ত পস্নাস্টিকেরপাত্র রাখা, ঋতুকালীন বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেয়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে) রাখার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু ছয় বছর পার হয়ে গেলেও পরিপত্রের নিদের্শনা বাস্তবায়নে উলেস্নখ্যযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে শতকরা ৮৪ ভাগ বিদ্যালয়ে টয়লেট থাকলেও সেগুলোর মাত্র ২৪ ভাগ উন্নত, ব্যবহারোপযোগী ও পরিচ্ছন্ন। প্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যবহার উপযোগী পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামোর অভাব রয়েছে।

উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ বন্ধে বাংলাদেশ অর্জন বেশ ভালো হলেও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির কারণে বছরে ৪২০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। এ অর্থ দেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করলে তার প্রায় ২ দশমিক ৩ গুণ বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। এ গবেষণায় আরও বলা হয়, প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে মাত্র দুটি পরিবার শিশুর মলমূত্র ঠিকমতো সরিয়ে ফেলে। অথচ মলমূত্রের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা না হলে অসুস্থতার ঝুঁকি থাকে, এমনকি শিশুর মৃতু্যও হতে পারে। মাটির গর্ত করে তৈরি করা প্রতি চারটি টয়লেটের মধ্যে একটি অস্বাস্থ্যকর এবং সেগুলোতে ঢাকনা না থাকায় তা পরিবেশ দূষিত করে। পয়ঃনিষ্কাশনের সঙ্গে শিশুর ডায়রিয়া ও খর্বকায়ত্তের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অনুন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে ডায়রিয়া, অন্ত্রের প্রদাহ ও কৃমির মতো সমস্যা দেখা দেয়। স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি জনগণের মধ্য সচেতনা তৈরি করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে