কাঁটাতার

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

সাদিয়া সৌমিতা
খুব সকালে বাবার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল ফারহার। ৮টাই তো বাজে, তবুও বাবা তাকে একরকম জোর করেই ঘুম থেকে ডেকে তুলল। ইদানীং বাবার ব্যবহার যে বদলে যাচ্ছে তা সে খুব ভালোই বুঝতে পারছে। সে যাই হোক, ঘুম থেকে উঠার পর বই খুলে বসতেই ফারহার সায়ানের কথা মনে পড়ল। হঁ্যা, ঠিকই চ্যাপ্টারটা তারা সেদিনও একসঙ্গে ডিসকাস করছিল। আজকে সায়ান তার থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। আর দূরত্বটা এমনই যে একই এলাকার মাঝে কাঁটাতারের মতো। কিছুদিন আগেও জীবনটা সুন্দর ছিল। সহজ ছিল। সমস্ত জটিলতার কারণ হয়তো তারা নিজেরাই। একে অপরের ওপর মুগ্ধ হওয়ার আগে তারা ভেবে দেখেনি যে, তাদের এত শত মিলের মাঝে শুধু ধর্মের দিক থেকে অমিল থেকে গেছে। আর এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফারহাকে নিজের মেয়ের মতো আদর করা। বাসার প্রাসাদের ভাগ দেওয়া সায়ানের মা আজ তাকে মেনে নিতে নারাজ। নিজের পছন্দেই বিয়ে করিস বলতে থাকা ফারহার বাবা এখন আর তার সঙ্গে নেই। বাসায় নিজেদের পছন্দের কথা বলার পরই সব এভাবে বদলে গেল। ফারহা শুধু ভাবছে, এই কি তার সেই বাবা? যিনি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করেন। বাবা হয়তো নিজের পছন্দে বিয়ে করা বলতে 'মুসলিম অভিজাত পরিবারের বিসিএস ক্যাডার সুদর্শন যুবক' বুঝিয়েছিলেন, তাই এই হিন্দু ধর্মের বিবিএ পড়া ছেলে তার চলবে না। কিন্তু ফারহার সঙ্গে সায়ানের যে মন একবারে জড়িয়ে আছে। তার মতো করে যে তাকে কেউ বুঝে না, তাতে কি? সেতো বাবার বেঁধে দেওয়া ছেলেদের দলে পড়ে না। যদি এত কিছুই দরকার ছিল, তবে কেন তাকে আগেই বলা হলো না যে তার মতের কোনো দাম দেওয়া হবে না। সে যাই হোক, বাবা রাজি না হওয়ায় চাচার কাছে শেষ মিনতি করতে গিয়েছিল ফারহা। চাচা আরও বেশি ধর্মের রেফারেন্স দিয়ে তার বাকি আশাটুকু শেষ করে দিলেন। আর সামাজিকতার পাঠ পড়ানোর জন্য তার মা-ই যথেষ্ট ছিল এবং তার উত্তরে সে একদম বলেনি যে তার সমাজ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। যখন সে নিজের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পায়নি তখন হতাশা থেকে সমাজ তাকে বাঁচিয়ে তুলতে আসেনি। এসেছিল সায়ান, সেই সায়ান। সমাজের গৎবাঁধা নিয়মের বাহিরে গেলে কী অদ্ভুতভাবে সবাই ধার্মিক হয়ে ওঠে! আজ যে চাচা ফারহাকে ধর্মের রেফারেন্স দিচ্ছে তাকে সে কোন দিন নামাজ পড়তে দেখেনি। এমনকি কোনো মানুষকে উপকার করতেও না। কিন্তু সায়ান একজন অসাধারণ মানুষ, অন্যকে উপকার করতে পারলেই তার শান্তি, তাতে কার কি? সে তো 'বিধর্মী'। দুটো মানুষ একে অপরের কতটা ভালোবাসে তবুও তারা অসহায়। তবুও তারা আলাদা। মায়ের ডাকে ফারহার ঘোর কাটল। বাবার মনমতো ছেলে এসেছে তাকে দেখতে। তাদের গল্পের ইতি ঘটাতে পুরো দুনিয়া যেন ব্যস্ত। ফারহা বইয়ের শেষ পেজে দুটো লাইন লিখে উঠে গেল, 'দুটো মানুষ, দুটো মন মিলে মিশে একাকার। তার মাঝে ইতি টেনে দেয় সাম্প্রদায়িকতার কাঁটাতার।