নীল খামে রঙিন চিঠি

প্রকাশ | ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
একটি চকচকে গাড়িতে দুজন লোক মাত্র। চালক ও কোয়েল। কোয়েলের স্বামী লাভলু মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি আনতে গেছে। কোয়েল বিয়ের পর এই প্রথম ধানমন্ডির ১০ নম্বর রোডে এলো। এই রাস্তার শেষ গলিতে একটি ভাড়াবাসায় থাকতো তার পরিবারের লোকজন। কিন্তু বাবার অবসরের পর তারা সবাই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। এক সময় এই রাস্তা দিয়েই প্রতিনিয়ত কলেজে যেত সে। এর প্রতিটি দোকান ও অলি-গলি তার কেমন যেন আপন আপন মনে হয়। স্মৃতি বড়ই বেদনা কাতর। কতই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই এলাকা ঘিরে। কোয়েল দরজা খোলে রাস্তায় নেমে আসে। ধীর পায়ে সামনে হঁাটে। ডানে-বামে তাকায় অবচেতন মনে। হঠাৎ সে থমকে দঁাড়ায়। দাড়ি-গেঁাফে মুখ ভতির্ একটি লোক। বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে পিঠ চেপে বসে ঝিমুচ্ছে। তাকে ঘিরে দঁাড়িয়ে আছে কতিপয় উৎকণ্ঠিত জনগণ। কোয়েল উৎসুক হয়ে এগিয়ে যায়। লোকটাকে কেমন যেন পরিচিত লাগছে। সে ফিসফিস করে বলে, ‘কে এই পাগল? কোথায় দেখেছি যেন তাকে! আমার কোনো আত্মীয় নয়তো?’ সে মনে প্রবল ধাক্কা খেল। জমে থাকা সব জড়তাকে পাশকাটিয়ে সে পাশে দঁাড়ানো মধ্যবয়স্ক লোকটিকে জিজ্ঞাস করে, ‘কে এই পাগল?’ প্রশ্নশুনে হাসে লোকটি। বলে, ‘ও হলো এ যুগের দেবদাস। বুঝলেন?’ লোকটির কথা কিছুই বুঝতে পারে না কোয়েল। সে আবার প্রশ্ন করে, ‘দেবদাস মানে?’ লোকটি বলে, ‘মানে বুঝলেন না? ধনী লোকের একমাত্র সন্তান, অনেক মেধাবী ছিল। সুন্দরী একটি মেয়েকে ভালোবাসতো; কিন্তু ওই মেয়ে নাকি অন্য একটি ছেলের হাত ধরে চলে গেছে। ওই মেয়ের জন্য সে এখন পাগল। প্রথম প্রথম লোকজন কিছুটা চিনত, এখন কোনো লোককে চিনে না। সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখলে ধাওয়া করে। এ রাস্তায় সে সারাক্ষণ ঘোরাফেরা করে। তার বিশ্বাস, তার মনের মানুষ একদিন না একদিন পাবর্তী হয়ে এখানে ফিরে আসবে। ঘটনা শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে কোয়েলের। তার কপাল কুচকে আসে। বুকটা কেন যেন ধুকধুক করে ‘ওর নাম কী জানেন?’ ওর নাম ফারহান’ ‘ফারহান!’ কোয়েলের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। মিনিষেই পায়ের নিচের সমস্ত মাটি সরে গেল যেন। সে চোখ বন্ধ করে দঁাড়িয়ে থাকে। এই সেই ফারহান, যে কলেজ জীবনের শুরুতেই কোয়েলের জীবনে এক মহামানব হিসেবে আবিভূর্ত হয়। প্রথম দৃষ্টিতেই ফারহানকে ভালোলেগে যায়। এক সময় এই ভালোলাগা, তপ্ত লোহ্য দÐের ন্যায় গলে গলে নিখাত ভালোবাসায় রূপ নেয়। কোয়েল তার ভালোবাসা নামক সা¤্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি করে নেয় ফারহানকে। ফারহান হয়ে উঠে ভালোবাসা নামক রাজ্যের একমাত্র রাজা। বড়লোকের নয়, ফারহান মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে; কিন্তু তুখোর মেধাবী। বুয়েটে পড়াশোনা করতো সে। ফারহানের কথায় যেন বিশ্বাসের সবের্শষ বিন্দুর পরশ পেত কোয়েল। তার চোখে চোখ রেখে হাজার বছরের স্বপ্নের রাস্তা দেখতে পেত। তার বুকের মধ্যিখানে মাথা রেখে নিরাপত্তার নিñিদ্র দুগের্র অনুভ‚তি পেত। তার বাহুবন্ধনে নিজেকে সপে দিয়ে স্বগীর্য় সুখের পরশ পেত কোয়েল। কথা ছিল পড়াশোনা শেষ হলেই এক ছাদের নিচে চলে আসবে তারা। হাজার বছরের স্বপ্নের সুতোয় গিট বঁাধতে শুরু করবে তারা। স্বপ্নের সুতোয় গিট বঁাধতে বঁাধতে এক সময় চুল-দাড়ি পেকে আসবে। চারিদিকে নাতি-নাতনির ভিড় জমে যাবে। এদের মধ্যেই তারা বেঁচে রবে যুগ যুগ ধরে। এরই মধ্যে ঘটে গেল মহাবিপত্তি। লাভলু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় টেন্ডারবাজি, চঁাদাবাজি করে বেড়াতো। একদিন সে কোয়েলকে প্রোপোজ করে। কিন্তু যে ভালোবাসা সে ফারহানের হাতে সপে দিয়েছে। যে ভালোবাসা আদান-প্রদানের চুক্তি হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই, তা কী ফিরিয়ে আনা যায়? সুতরাং যা হওয়ার তাই হলো। লাভলুকে ‘না’ বলে দিয়েছে সে। পরের দিন তার জীবনের ওপর দিয়ে এক প্রলঙ্করী টনেের্ডা বয়ে যায়। কে বা কারা তাকে কলেজে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য কোয়েল জানতে পারে লাভলুর লোকজন তাকে উঠিয়ে এনেছে। বিকেল বেলা তার মা-বাবাকেও উঠিয়ে আনল এবং বলা হলো লাভলুর সঙ্গে বিয়েতে রাজি না হলে তার মা-বাবা ফিরে যাবে না, ফিরে যাবে তাদের মৃত দেহ। কোয়েল তখন অথৈই সাগরে হাবুডুবু খাওয়া এক মৃত্যুপথযাত্রী। একদিকে ফারহানের ভালোবাসা, অন্যদিকে তার মা-বাবার জীবন। কোয়েল জানে থানা-পুলিশে লাভলুর কিছু হবে না। সুতরাং বাধ্য হলো এই বিয়েতে রাজি হতে। লাভলু নিরেট কোয়েল পেল ঠিকই কিন্তু কোয়েলের নিরেট ভালোবাসা পায়নি কোনো দিন। বিয়ের পর কোয়েল তার মা-বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। সে এখন বন্ধ খঁাচায় আবদ্ধ পাখির ন্যায় স্বাধীনতাহীন এক পোয়া প্রাণী। লাভলুর বদ স্বভাবের কারণে কোয়েল সবর্দা জড়সড় হয়ে থাকে। এমনকি শারীরিক নিযার্তনের ভয়ে সে মত প্রকাশের সুযোগও পায় না। ভাবতে ভাবতে কোয়েলের দুচোখের জল টলমল করে উঠে। ‘একটা পাগলকে এমন হ্যাবলার মতো দেখার কি আছে?’ পেছন থেকে লাভলুর গলার ককর্শ শব্দে হতচকিত হয়ে পড়ে কোয়েল। সে শাড়ির অঁাচল কামড়ে ধরে দ্রæত পদে গাড়িতে উঠে বসে। ধ্রিং ধ্রিং শব্দে গাড়ি স্টাট নেয়। রাত আড়াইটা বাজে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় কোয়েলের। আজ লাভলু বাসায় আসেনি। এটা নতুন কিছু নয়। লাভলু প্রায় রাতেই বাসায় আসে না। জানতে চাইলে বলে, ‘সব কথা ঘরের বউকে বলা ঠিক না।’ কোয়েল লাইটের সুইচ অন করে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পুরনো আলমারিটার দিকে। আস্তে করে দরজা খোলে আলমারির। শত শত নথির মধ্যে চাপা দিয়ে রাখা একটি নীল খাম বের করে আনে। শাড়ির ভঁাজে খামটি চট করে লুকিয়ে ফেলে, যদি কেউ আবার দেখে ফেলে! সে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। শাড়ির ভঁাজ থেকে নীল খামটি বের করে আনে। নীল খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি রঙিন চিঠি। এই চিঠিটিই ফারহান কতৃর্ক কোয়েলকে প্রদত্ত শেষ চিঠি। চিঠি পড়তে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কোয়েল। শত স্মৃতি তার একে একে মনে পড়ে। সে শাড়ির অঁাচল দিয়ে চোখের জল মুছে। ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে উঠে দঁাড়ায়। ‘না, আর ধৈযর্ধারণ নয়, এখনই আমাকে বেরোতে হবে এই অগ্নিগহবর থেকে। ফারহানকে নিয়ে তাদের বাসায় যেতে হবে। না না, ফারহানদের বাসায় যাওয়া যাবে না। লাভলু সেখানেও হানা দেবে। হ্যঁা হ্যঁা, সেখানেই যাব, যেদিকে দুচোখ যায়। যে করেই হোক ফারহানকে সুস্থ করে তুলতেই হবে।’