অন্য মানুষ

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

জুয়েল আশরাফ
আব্বাস আলী ঘরে শুয়ে আছেন। তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। ভেবেছেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ব্যথা বাড়তে থাকে। বিছানায় শুয়ে তিনি ড্রয়িং রুমে তাকালেন। টিভিতে জোরে জোরে নিউজ রিডারের শব্দ ভেসে আসছে। তার স্ত্রী রেবেকা আর দুই সন্তান তাদের মোবাইলে কিছু দেখছে। আব্বাস আলী বিছানা থেকে নামলেন। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরে পৌঁছালেন। রেবেকার দিকে তাকালেন। তার পায়ের শব্দ পেলেন না, কারণ রেবেকা মোবাইলে একটি ভিডিও দেখছেন। মোবাইল থেকে জোরে আওয়াজ ভেসে আসছে। আব্বাস আলী কাতর গলায় বললেন, টিভিটা এবার বন্ধ কর, খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। রেবেকা আব্বাস আলীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ? আব্বাস আলী বললেন, সকাল থেকে বুকে ব্যথা, তাই ডাক্তার দেখিয়ে আসি। বসে থাকতে থাকতে রেবেকা বললেন, যাও, তোমার দরকার হলে আমাকে ফোন করে ডেকো। ছেলেমেয়ে দু'জন এখনো মোবাইলে নিজে থেকে কিছু একটা দেখছে। বাবার দিকে তারা ফিরেও তাকাল না। নিচে নেমে বাইরে এসে গাড়ি পেলেন না। দবীর উদ্দিন ঠিক এই মুহূর্তে গেট দিয়ে ঢুকছে। ছয় তলা এই বাড়ির সে কেয়ারটেকার। তার চোখ পড়ল আব্বাস আলীর দিকে। তাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা, আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে? অনেক ঘামছেন! আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আপনার জন্য মোড়ে গিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে আসি। আপনি কোথায় যাবেন? আব্বাস আলী বললেন, তুমি ঠিক বলেছো দবীর। আমার শরীর ভালো নেই, তাই আমি ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছি। দবীর আব্বাস আলীকে সিএনজিতে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। পথিমধ্যে আব্বাস আলীর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে থাকে। হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হুইলচেয়ারে করে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বললেন, আপনি সময়মতো তাকে নিয়ে এসে তার জীবন বাঁচিয়েছেন। তার মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখনই অপারেশন করতে হবে। আপনি তার বাসা থেকে কাউকে ফোন করুন কারণ অপারেশনের আগে কাগজের সাইন নিতে হবে। হাসপাতালে আসার পর থেকেই দবীরের ফোন বারবার বেজে উঠছে। সে ফোনে জানিয়ে দিল, আমি আজকে কাজে আসছি না। আমার বেতন থেকে আমার টাকা কেটে নিন। তারপর আবার ফোন বেজে উঠল। দবীর দেখল, আব্বাস আলীর স্ত্রী রেবেকার ফোন এসেছে। রেবেকা তাকে বকাঝকা করে বললেন, তুমি আজ কাজে এলে না কেন দবীর, তোমার বেতন থেকে টাকা কেটে নেব। দবীর আতঙ্কিত হয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলল। দ্রম্নত হাসপাতালে পৌঁছাতে বলল। আব্বাস আলীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসকরা তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু কাগজে সই-সাবদ এখনো বাকি। ডাক্তার দবীরকে ডাকলেন। দবীর কাছে এগিয়ে গেলে আব্বাস আলী বাড়ির লোকজনের আসার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তিনি দবীরের দিকে ইঙ্গিত করে ডাক্তারকে বললেন, আমার দুই সন্তানের চেয়ে এই সময়ে আমার জন্য একজন সন্তান আছে। ডাক্তার আমি আপনাকে অনুরোধ করছি কাগজে তার সই নিয়ে আমার অপারেশন শুরু করুন। আব্বাস আলীর অপারেশন শুরু হয়। রেবেকা হাসপাতালে এসে পৌঁছেছেন। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছেন। অপারেশনের পর আব্বাস আলী চোখ খুললে স্ত্রী রেবেকা আর ছেলেমেয়ে দুজনকে সামনে দেখতে পেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দবীরের কথা জিজ্ঞেস করতে থাকেন। দবীর এখন বাইরে নামাজের স্থানে বসে সামনে হাত জোড় করে আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা করছে। রেবেকা দবীরকে ভেতরে ডাকলেন। আব্বাস আলী কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকলেন দবীরের দিকে। যেন তিনি বলতে চাচ্ছেন- 'আমার জীবন বাঁচানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমার আপনজনের চেয়েও বেশি কাজ করেছ। আজ আমি বেঁচে আছি শুধু তোমার জন্য।' মনের মধ্যে চলা এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে দেখাতে চেয়েছেন ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকেও, যারা মোবাইলের কারণে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। আপনজনের কষ্ট তাদের অনুভূতি উপলব্ধি করা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।