এক জীবনের চাওয়া-পাওয়া

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
বাজারের প্রবেশ পথে একটি বাটি সামনে নিয়ে বসে আছে জব্বার। পায়ের গোড়ালিতে দগদগে একটি ঘা। মানুষজন ঘা দেখে দয়াপরবশ নগদ অর্থ দান করে যায়। ভিক্ষা করতে জব্বারের আর লজ্জা লাগে না। প্রথম যেদিন সে রাস্তায় বাটি হাতে নেমেছিল লজ্জায় তার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। এক পরা বাস্তবতা তাকে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য করেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। \হপ্রথম ছেলে যেদিন জন্ম নেয় সেদিন জব্বার যেন আকাশের চাঁদ দু'হাতের মুঠোয় পায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল জব্বার। ছেলের মুখের হাসি দেখে জাগতিক সব সুখের স্বাদ পেয়েছিল। তখন সে টাগরা জোয়ান ছিল। পুকুর ভরা মাছ ছিল, গোয়াল ভরা গরু। কত সুখের সংসার ছিল তার। দু'বছর পর একটি মেয়ে জন্মেছিল। কি ফুটফুটেই না ছিল মেয়েটি। কিন্তু নানা অসুস্থতায় ভোগছিল মেয়েটি। অনেক অর্থ ব্যয় করেও অবশেষে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখা গেল না। আর কোনো সন্তান নেয়নি সে। 'এক পোলার কোনো ভরসা নাই'। মানুষের এমন কথার জবাবে জব্বার বলত, 'ক্ষেতের মতো ক্ষেত যেমন একটাই ভালো; তেমনি পুতের মতো পুত একটাই যথেষ্ট।' \হছেলের বয়স যখন সাত, তখনি আরেক বিপদ নেমে এলো তার সংসারে। হাতের পাঁচ, একমাত্র ছেলে আক্রান্ত হলো দুরারোগ্য ব্যাধিতে। জব্বারের চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার। একমাত্র ছেলের কিছু হলে কি নিয়ে বাঁচবে সে। সে ডাক্তারকে বলল, 'ডাক্তার সাব, আমার চোখের মনিকে আপনি সুস্থ করুন যত টাকা লাগে আমি দিব।' ডাক্তারের পরামর্শে ছেলেকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসা করানো হলো। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল তার একমাত্র ছেলে কিন্তু সহায় সম্পত্তি সব বিক্রি করে নিঃস্ব হলো জব্বার। তারপরও সে সান্ত্বনা পেত এই বলে- 'একমাত্র ছেলে বেঁচে না থাকলে কি হতো সম্পত্তি দিয়ে। ছেলে বেঁচে থাকলে এরকম সম্পত্তি কত হবে!' একদিন জব্বারের স্ত্রী আদুরে গলায় বায়না ধরল- দেখ, আমাদের তো আর দশটা/পাঁচটা ছেলে না। একমাত্র ছেলে। আমি ছেলেকে বিয়ে করাতে চাই। ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে চাই। নাতি-নাতনি দেখতে চাই। একমাত্র ছেলের বউ, নাতি-নাতনির মুখ দেখতে ছেলেকে বিয়ে করাল জব্বার। একটি পরিপূর্ণ সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল সে। \হকিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই তার সংসারে পেতাত্তার ছায়া এসে পড়ল। ছেলে বউ তো নয় যেন সাক্ষাৎ দাজ্জাল এসে ঘরে ঢুকেছে! কথায় কথায় ঝগড়া শুরু করে দেয় ছেলের বউ। জব্বারের স্ত্রীকে সহ্যই করতে পারে না মেয়েটা। বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করে। কিছু বলতে গেলে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। জব্বার চুপসে যায়- এ মেয়ে যদি এই বাড়িতে সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করে বসে তাহলে তো আমাগো সারাজীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। \হতার হাতের পাঁচ, একমাত্র ছেলেকেও এক সময় অপরিচিত মনে হয়। পিতা-মাতাকে দেখলেও মুখ কালো করে রাখে। দেখেও না দেখার ভান করে। একদিন ছেলের বউ জব্বারের মুখের ওপর বলল- সব সম্পত্তি বিক্রি করে পেটের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। নাতি-নাতনিদের জন্য রাখেননি তো কিছুই। এবাড়িতে এসে একটা ভাতের হাড়ি ছাড়া আর কী পেয়েছি? জব্বার উত্তরে বলেছিল- ছেলের চিকিৎসা খরচ দিয়েই তো আজ আমি নিঃস্ব। ছেলের বউ মুখে ভেংচি কাটে। বলে- সে তো নিজেদের সুখের জন্যই....। ভেবেছেন ছেলে বড় বড় মাছ কিনে আনবে আর আপনারা গাল ভরে খাবেন। ছেলে বউয়ের এরূপ আচরণে মানসিকভাবে আহত হয় জব্বার। এক সময় সুখের সন্ধ্যানে ছেলে-ছেলের বউ ঢাকা শহরে পাড়ি জমায়। খোঁজ-খবর নেয় না পিতামাতার। এদিকে জব্বার মাছ ধরে, বিক্রি করে ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন মরা শামুকে পা কেটে যায় তার। পচন ধরে ক্ষতস্থানে। মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। অর্ধাহারে-অনাহারে বিছানায় পড়ে থাকে সে। একমাত্র সম্বল ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জব্বার। কিন্তু তার স্ত্রী বাধা দিল- না, অন্তত এই ভিটে-বাড়িটা নাতিদের জন্য রেখে যেতে চাই। প্রয়োজনে আমি মানুষের কাছে চেয়ে তোমাকে খাওয়াব। বউয়ের মুখ চেপে ধরে জব্বার। না, আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে মানুষের কাছে হাত পাততে দেব না। আমিই বরং পথে নামব। স্ত্রীর চোখের জল মুছে, লাঠিতে ভর দিয়ে জব্বার বাটি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।