জ্যোৎস্না রাতে

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
আমি পূবার্কাশের উদীয়মান লাল টকটকে সূযর্টা দেখিনি। আমি পশ্চিমাকাশের গোধুলী লগ্নের মায়াবী সৌন্দযর্টাকে দেখিনি। দেখিনি দখিনা বাতাসে শত শত কাশফুলের নৃত্যাভিনয়। দেখিনি উত্তরে বয়ে চলা নদীর মৃদু স্রোতধারার অপার মহিমা। অন্ধকারে যে প্রদীপ তুমি আমার হাতে দিয়েছ, সে প্রদীপের মৃদু আলোয় আমি কেবল দেখেছি তোমার কপালের সেই লাল পিপের সম্মোহন। তোমার দুঠেঁাটে লেপ্টে থাকা মোলায়েম হাসির ঝিলিক। দুগালের ওপর ভেসে ওঠা টুলের আহŸান। তাইতো আমি দেখতে চাইনি নাটোরের বনলতা সেনের চুলের ঝলকানি; কিংবা যাচাই করতে চাইনি লাইলী-মজনু শিরি-ফরহাদের ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু। এভাবেই রুবির প্রশংসা করছিল রাসেল। এতক্ষণ রাসেলের কঁাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুনছিল রুবি। এবার সে চোখ খুলল। রাসেলের চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। রাসেলের গাল টেনে বলল, হয়েছে; আর প্রশংসা করতে হবে না। -সত্যি কথা বলতে কি, তোমার মতো একজন নারী আমি বলব মহীয়সী নারী আমার পাশে না থাকলে, তোমার অনুপ্রেরণা না পেলে, আমি এতদূর আসার ধৈযর্্য ও শক্তি হয়তো বা পেতাম না। রাসেলের ঠেঁাটে হাতের আঙুল চাপা দিল রুবি। বলল, এমন করে বল না। তোমাকে অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্যই যে আমার জন্ম। রাসেল রুবির বিয়ের বয়স এখনো বছর পূণর্ হয়নি। ছমাস হলো এই ছাদওয়ালা একতলা বাসাটায় তারা উঠেছে। সাধারণত তারা রাতে ছাদে উঠে না। আজই প্রথম জ্যোৎস্নারাতে তারা ছাদে উঠেছে। সন্ধ্যা হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। রাতের আকাশ খুব পরিষ্কার। চারিদিকে তারা আর মধ্যমনি চঁাদের আলোয় পৃথিবী যেন অবগাহন করছে। হঠাৎ রুবি লাফিয়ে উঠল। -ওই দেখো, আকাশ থেকে একটি তারা খসে পড়ল যেন। -হু, আকাশের তারা খসে পড়লেও আমাদের মনের আকাশের তারা কিন্তু উদিত হচ্ছে। -আবারও ফাজলামু, রাসেলের পিঠে আলতো চড় দিয়ে বলল রুবি। রুবি যেন চমকে উঠল। এমনভাবে রুবি আবার বলল, ও হ্যঁা, জানো? আজ কিন্তু তোমার চাকরির বছর পূণর্ হয়েছে। -তাই নাকি? একটু চঞ্চল হয়ে উঠে রাসেল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার কপালে একটি ভঁাজ পড়ে। মিনমিন করে বলতে থাকে, রুবি, চাকরি পাওয়ার পূবের্র সময়ের কথা মনে পড়লে আমি এখনো অঁাতকে উঠি। - কেন, কেন? কারণ, তখনকার প্রতিটা নিঃশ^াস ছিল আমার জন্য কঠিন যন্ত্রণার। একদিকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে জুতার সোল্ড ক্ষয়। অন্যদিকে চাকরির ব্যাংক ড্রাফট কিনতে কিনতে একেবারে ফতুরে অবস্থা। তখন তোমার ঘাটের পয়সা খরচ করে আমাকে বই কিনে দিয়েছ; এমন কি আমার মাসের খরচটা পযর্ন্ত তুমি ম্যানেজ করেছ। আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। সে সময় তোমার অনুপ্রেরণাই ছিল আমার একমাত্র চালিকাশক্তি। এক সময় আমার মনে হয়েছিল অভাবের তাড়নায় তোমাকে হারাতে বসেছি বুঝি। -আমার কিন্তু মোটেও তেমন মনে হয়নি। কারণ, আমি তোমার চাকরিকে ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছিলাম তোমার চেতনা আর আদশের্ক। তুমি সেদিন চাইলে তোমার হাত ধরে আমি চলে আসতাম। কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম, তোমার বাবা-মার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য অন্তত তোমার একটা চাকরি হোক। -জান রুবি, তোমার বাবা সবের্শষ যেদিন আমাকে তোমাদের বাসায় ডেকে নিয়েছিল, সেদিন কী বলেছিলেন? -কী বলেছিলেন? -তিনি অত্যন্ত নরম স্বরে বলেছিলেনÑ দেখো বাবা, আমার একমাত্র মেয়ে তোমাকে ভালোবেসেছে। তোমাদের ভালোবাসাকে আমি অবহেলা করতে পারি না বরং শ্রদ্ধা-ই করি। ভালোবাসা খারাপ নয়। আমরাও তো ভালোবেসে বিয়ে করেছি। কিন্তু বাবা, তোমার পরিবারের অবস্থা তেমন স্বচ্ছল না। তোমার চাকরি হচ্ছে না। এই অবস্থায় আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না। আমি কেন, কোনো বাবার পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। এদিকে মেয়েরও বয়স বাড়ছে, সেই সঙ্গে আমাদের চিন্তাও। আমি তোমাকে ছয় মাস সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে চাকরির কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলে আমার মেয়ের আশা তুমি ছেড়ে দিও। জান, সেদিন রাত্রে আমার দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভয়ানক বেদনা-বিদুর একটা রাত আমি কাটিয়েছিলাম। সারারাত ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন? মা বলেছিলেন তার এক দুসম্পকের্র খালাতো ভাইনাকি সরকারি অফিসের বড় কমর্কতার্। তিনি নাকি আমার চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবেন বিনিময়ে মোটা অংকের ঘুষ চান। একবার ভেবেছিলাম ভিটেমাটি বিক্রি করে কথিত ওই মামাকে ঘুষ দিয়ে একটা চাকরি নিয়ে নিই। কিন্তু পারিনি। বিবেক আমাকে বাধা দিচ্ছিল। এত ভালো রেজাল্ট করেও দুনীির্তর মাধ্যমে আমাকে চাকরি নিতে হবে? বলতে বলতে রাসেলের দুচোখের কোণে পানি এসে যায়। ওড়না দিয়ে আলতো করে রাসেলের চোখ মুছে রুবি। বলে, আমার একটা কথা রাখবে? এ দেশ ভালোবেসে যেহেতু তোমাকে একটি সম্মানজনক চাকরি দিয়েছে। তোমাকে সম্মানের আসনে আসিন করেছে। সুতরাং সবসময় চেষ্টা করবে নিজে ঘুষ, দুনীির্ত থেকে বিরত থাকতে; অন্যকে ঘুষ, দুনীির্ত থেকে দূরে রাখতে। কখনো অন্যায়ের আশ্রয় নেবে না। কারণ আমরা আমাদের অনাগত শিশুর জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই। -অবশ্যই। রুবি, এ দেশ আমায় ভালোবাসার পরশ। এ দেশ আমার মায়ের মমতা। আমার মাকে যেমন আমি কলঙ্কিত করতে পারি না। তেমনি এ দেশকেও আমি কলঙ্কিত করতে পারি না। রাসেল রুবির থুতনিতে ধরে বলল, এই রুবি, এবার একটু হাসতো। কতক্ষণ তোমার এই চঁাদ রূপ মুখের হাসি দেখি না। অতপর তারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তাদের হাসির ঝিলিকে চঁাদের আলো যেন ম্রিয়মান মনে হলো। সদস্য জেজেডি ফ্রেন্ডস্ ফোরাম, ময়মনসিংহ