ঘুষ

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
এক বিষাক্ত সাপে আমাকে ছোবল দিয়েছে। আমার চোখের সামনে সাপটি বুকে ভর দিয়ে চলে গেল। ধীরে ধীরে, আরামে। কোনো তাড়াহুড়া নেই তার। আমি ইচ্ছা করলেই সাপটিকে ঝাঁপটে ধরতে পারতাম। কিন্তু এক অজানা আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরল। সাপটি ছোবল দিয়েছে আমার ডান পায়ের বৃদ্ধাঙুলিতে। মুহূর্তেই বৃদ্ধাঙুলিতে তীব্র ব্যথা শুরু হয়ে গেল। সেই সঙ্গে আঙুলের রঙ নীল বর্ণ ধারণ করেছে। আস্তে আস্তে বিষের তীব্রতা পায়ের ওপরের দিকে বিস্তৃতি লাভ করতে লাগল। ডান পায়ের হাঁটু অবধি নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। ব্যথায় কুঁকাচ্ছি আমি। সারা শরীর জুড়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছি। হাত-পা, পেট সারা শরীর বিষের প্রভাবে নীল হয়ে আসছে। আমি আর পারছি না। ব্যথার তীব্রতা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে আমার। কিন্তু কান্নার শব্দ গলায় আটকে যাচ্ছে। কেন যেন কাঁদতে পারছি না। কান্নার আওয়াজ গলার বাহিরে আসছে না। বিষধর সাপে কামড়ালে মানুষ বাঁচে না। আমি হয়তো আর বাঁচব না। মরে যাচ্ছি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলের ফুটফুটে নিষ্পাপ মুখখানি আমার অন্তর চোখে ভেসে এলো। আমি গোঙাতে লাগলাম। আহা! ছেলেটার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। আমি ওকে মানুষ করে যেতে পারলাম না। হে বিধাতা, তুমি ওকে ভালো রেখো। আমি নিশ্চিত করেই মরে যাচ্ছি। হাসপাতালে যেতে চাইলেও পাথিমধ্যে মরে যাব। আমার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। আমার বাবা মারা গেছেন ১০ বছর আগে। বাবার চেহারা আমার হৃদয় চক্ষু হতে ঝাঁপসা হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে তার কণ্ঠও হয়ে আসছে অচেনা। কিন্তু বাবার মতো কণ্ঠে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। আমি ডানে-বামে তাকালাম। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পেলাম না। আবার আমি সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। -এই যে আমি তোমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছি। -বাবা তুমি! ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। উজ্জ্বল আলোতে বাবার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাবাকে এত দিনপর দেখে আমার চোখ ছানাভরা। -জনি, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? -বাবা, আমি মরে যাচ্ছি। মরে যাচ্ছি বাবা। আমার সারা শরীর ব্যথায় নীল হয়েছে দেখ। আমি আর পারছি না। বাবা নির্বাক, নিষ্পলক। আমি লক্ষ্য করলাম তার কোনো ভাবান্তর হলো না। -কিন্তু তুমি মরবে না। অনবরত কষ্ট ভোগ করবে। ছটফট করবে যন্ত্রণায়। বাবার কথায় আমি আশ্চর্য হলাম। চোখ বড় বড় করলাম। বাবা কেন এমন কথা বলছে বুঝতে পারছি না। -কি বলছ বাবা! বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম- ঠিকই বলছি। গত সপ্তাহে কত জঘন্য কাজ তুমি করেছ। তা কি তুমি বুঝতে পারছ? -জঘন্য কাজ করেছি মানে? - ও, তা হলে বেমালুম ভুলে গেছ! বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। গতকাল তুমি অফিসে এক বৃদ্ধের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছ, বাবা আরো কঠিন কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, টাকাটা নেয়ার সময় তোমার হাত একটুও কাঁপেনি? বাবার কথা শুনে আমার বুকে কাঁপন ধরল। -বাবা, তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলব না। সত্যিই টাকাটা নেয়ার সময় হাত কেঁপেছে। এই প্রথম তো। বাবা, আমি চাকরিতে জয়েন করেছি মাত্র ছমাস হলো। এই কদিনে কত জনকেই তো দেখলাম ঘুষ নিতে। তা হলে আমি নিলে ক্ষতি কী? বাবা আবার চোখ বড় বড় করলেন। তোমাকে তো অনেকবারই বলেছি, স্বাধীনতার সময় দেশ ছিল অস্থির। এখন দেশে স্থিতি আসেনি? আগে শিক্ষিত লোকের হার ছিল কম, এখন বাড়েনি? আগে মানুষ না খেয়ে মৃতু্যবরণ করেছে, এখন কজন মানুষ অভুক্ত থাকে? আগে চাকরির ব্যবস্থা ছিল নগণ্য, এখন বেশি বেশি চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে না? তুমি একজন শিক্ষিত তরুণ, তোমার মতো তরুণ চাকুরেরাই হবে সমাজ বদলের হাতিয়ার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার শপথ তোমাদেরই নিতে হবে। আর এই তোমরাই দুর্নীতি করলে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হবে কীভাবে? আমার গাঁ ছুয়ে পণ কর, আর কখনো ঘুষ নেবে না বা কাউকে ঘুষ নিতে দেখলে প্রতিবাদ করবে। আর যদি না করো তা হলে এই বিষাক্ত সাপের ছোবলে তোমাকে মরতে হবে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম শীতের রাতেও আমার সারা শরীর ঘামছে। তার চেয়ে বড় কথা, মনে হচ্ছিল আমার সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা তখনো রয়ে গেছে। পরের দিন অফিসে এসেই ওই চাচাকে ফোন দিলাম। আমার জরুরি তলব পেয়ে চাচা হন্ত-দন্ত হয়ে অফিসে হাজির। আমি চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। আসলে এক অস্থিরতা আমাকে আষ্টে-পিষ্টে ধরেছিল এবং এই অস্থিরতা থেকে আমি মুক্তি চাচ্ছিলাম। চাচা সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। আমার স্থিতি ফিরে এলো। চাচাকে আমার সামনে পাতা চেয়ারে বসতে বললাম। ডান পাশের ড্রয়ার টেনে পাঁচ হাজার টাকা চাচার হাতে দিয়ে বললাম- চাচা আমাকে ক্ষমা করুণ; আমি আপনার টাকা নিয়ে ভুল করেছি। চাচা টাকাটা হাতে নিয়ে কান্না শুরু করে দিল। ভাবলাম চাচ হয়তো টাকা ফেরত পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে, কিন্তু না। চাচার বিস্ফোরক কথা শুনে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অপরাধী মনে হলো। চাচা কেঁদে কেঁদে বললেন- এই টাকাটা আমি হয়তো পেলাম কিন্তু আমার চাঁদমুখ নাতিকে তো আর পাব না। আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম- মানে? তিনি বললেন- আমার একটা খাসি ছিল। ঐ খাসিকে আমার আট বছর বয়সী একমাত্র নাতি কাঁঠাল পাতা খাওয়াত, ঘাস খাওয়াত, ভূষি খাওয়াত, গলায় ধরে আদর করত আর বলত- এটা আমার খাসি। এটা আমার খাসি নয় দাদা? অন্য কোনো পথ না থাকায় এই খাসিটা বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা আপনাকে দিই। খাসি বিক্রি আমার নাতি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আমার নাতি প্রতিদিন কান্নাকাটি করে বলত- আমার খাসি বিক্রি করেছ কেন? আমার খাসি এনে দাও। তার মা একদিন বিরক্ত হয়ে ছেলেকে বকা দেয়। বকা খেয়ে রাগে সে সারাদিন বাড়ি ফিরেনি। সন্ধ্যায়ও বাড়ি না ফিরলে সবাই আমরা খুঁজতে বের হই। অবশেষে আমার নাতিকে নয়, আমার নাতির লাশ পাওয়া যায় পাশের ডুবার পানিতে। আমার যক্ষের ধন, আমার একমাত্র নাতি হারিয়ে গেছে অন্ধকারের ওই অতল গহ্বরে। এখন আমি এই টাকা দিয়ে কী করব বাপু! চাচার চোখের পানিতে তার দাঁড়ি ভিজেছে। আমার টেবিল ভিজেছে আর ভিজেছে আমার হৃদয় নামক কোমল গহ্বরটি। সদস্য জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম \হময়মনসিংহ