প্রতিক্ষার অবসান

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

মো. ইব্রাহিম খলিল
একদা সহপাঠীদের সঙ্গে ঘুরে ফিরে আনন্দে কিছু সময় কাটাতে গিয়েছিলাম সীতাকুন্ডের ইকোপার্কে। গিয়ে দেখি সেখানে চড়ুই ভাতির আয়োজন। আমি আর সোহান সেলফি তোলার জন্য, পার্কের বিভিন্ন প্রান্তে দৃশ্য খুঁজি; বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। এমনি অভ্যাস অফিস ছুটির দিন অথবা কোনো বিশেষ দিনে দুজনেই এক সঙ্গে চলে যেতাম। বেলাভূমি সৈকতপাড়ে, পাহাড়ের অরণ্যঘেরা লেকসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। উদ্দেশ্য শুধু একটাই সেলফি তোলা। তবে উপকূলে সমুদ্র সৈকত, অরণ্যঘেরা লেকপাহাড় যেখানেই যায়; দেখি শুধু বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণে আশা ছেলেমেয়েরা পরস্পর হাত ধরে বা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। এমনকি একে অপরের বসনে শুয়েও আছে। আজকাল স্কুল-কলেজ পড়ুয়া প্রেম শিকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসও চলে পার্কে পার্কে। কিন্তু সেদিন চড়ুইভাতির আয়োজনে সীতাকুন্ড ইকোপার্কে আমি আর সোহান যেদিকেই যাই চোখে পড়ে জোড়া পাখির মিলন। হতাশা বোধ করি নিজেকে; কারণ- যুবক-যুবতীদের মধ্যে সচেতনতার এতই অভাব, কাকে বিশ্বাস করব। অসামাজিক কার্যকলাপ এতই বৃদ্ধি পেয়েছে কল্পনাতীত! 'আমি আপন মনে চুপি চুপি স্বপ্ন বুনি'। ছোট থেকে কোনো একটা মেয়েকে বক পাখির মত চোখে চোখে রেখে শিকার ধরে থাকতে হবে। না হয় সৎ মেয়ে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আবার এমনও ভাবি যে, 'ও' এবং 'ওর' বাবা-মা আমাকে জানবে না, ওদের সঙ্গে থাকবে না আমার কোন চেনা পরিচয়। আবার আমার বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে আমি হলাম পঞ্চম। সিডিউল আমার অনেক পরে। কিন্তু মেয়েটা যখন একটু বড় হবে, বা এসএসসি পাস করবে তখন সচ্ছল একটা ঘর আসলেই বিয়ের পিড়িতে বসবে, স্বাভাবিক। আমার জন্য কি অপেক্ষা করে থাকবে? চিন্তা করি সংকল্প আঁকি, কোন আত্মীয়ের মধ্যে সম্পর্কটা হলে ভালো। চেনা জানা থাকবে, সে তো আমার পরিচিতা আমি হব তার মতন, সে হবে আমার মনের মতন। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ছিলাম; পাকা ঘর নির্মাণকালে ছাদ ঢালায়ের সময় নিমন্ত্রণ পেয়ে মায়ের সঙ্গে মিষ্টি নিয়ে অথিতি হয়ে গেলাম; খালা মনির বাসায়। দৃষ্টি পড়ে সাত-আট বছরের শ্যামলা বর্ণের একটা মেয়ে, মায়ের সঙ্গে আমাকে আপ্যায়ন করাচ্ছে। ওকে ডেকে পরিচিত হলাম সে আমার খালাত বোন, নাম তার নূরী। সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে পড়ার টেবিলে পাঠ্যবইয়ের গল্প-কাহিনীর মধ্যে দিয়ে পড়ালেখা ও আদর্শের প্রতি কিছুটা অনুপ্রাণিত করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম বুদ্ধিমত্তা ভালো মেজাজটা কিন্তু তিরিক্ষি! নূরীর বাবা-মা অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত। বাবার পেশা ছিল কৃষি। সেই থেকে নূরীকে আমার মন মঞ্জুরে বসাই। তবে কেউ যেন বুঝতে না পারে তাই আপন মনে চেপে রাখি। একবার খালামনিকে নূরীর পরীক্ষার কথা প্রশ্ন করে উত্তর পাই, পাসতো করেছে তবে অতো ভালো না। কারণ 'ও'কে দেখার মতো কেউ নেই। তখনই নূরীকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসে ''কাটগড় সরকারি (প্রা.) বিদ্যালয়ে'' চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি কওে দেই। পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার জন্য শপিংও কওে দেই। সেই থেকে তাকে আমি দেখভাল করি এবং অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করি। পরের বছর সে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে আবারও চলে যায় আপন গাঁয়ে। ভর্তি হয় পাড়ার একটি স্কুলে। সেখানে আমি কয়েক দিন পর পর বিদ্যালয়ে গিয়ে কোচিং ফি পরীক্ষার ফি দিয়ে আসতাম এবং শিক্ষকদের বলতাম 'ওর' পড়ার প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য। এভাবে করে নূরী জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো ফল পেয়েছে। এইবার এইচএসসিতে ভর্তি করে দিলাম। নূরী এইচএসসিতে থাকাকালে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছিল। অভিভাবক হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। নূরীর আবৃত্তি বিভাগে যখন নাম ঘোষণা করল, সে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি সুখের 'উলস্নাসে' কাবিতাটি আবৃত্তি করল। কি চমৎকার তার বাচন ভঙ্গি! কত শুদ্ধতার উচ্চারণ! কত সরল তার উপস্থাপনা। তার এক একটা শ্রম্নতিমধুর শব্দ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল উর্মিমালার মতো, আমি যেন হারিয়ে গেলাম তার আবৃত্তিতে। অনুষ্ঠান শেষে অধ্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি বলেন: বিভিন্ন বিষয়ে নূরীর তীক্ষ্ন জ্ঞান; পড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। বাসায় একটু নজর রাখবেন। এবার নূরীকে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে বললাম, তোমার যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে জানিও। সে বছর নূরী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ইতোমধ্যে পত্রিকায় (প্রা:) বিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে। তাকে বললাম, সব সনদপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি ও একটা দরখাস্ত লিখে নিয়ে এসো। আমি সব দেখে খামে করে ডাকযোগে পাঠিয়েছি। এরপর সাফলিমেন্টারি ও নিয়োগ গাইড ক্রয় করে দিলাম। সে পুরোদমে পড়ালেখা শুরু করল। মাস দুয়েকের মধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র এসেছে তার হাতে। পরীক্ষার হল 'চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে'। পরীক্ষার আগের দিন নূরীর বাবা এস বললেন, আমরাতো শহুরে কিছুই চিনি না, 'ওতো মেয়ে মানুষ একা কোথায় যাবে? তুমি একটা ব্যবস্থা করলে কৃতার্থ হতাম। আমি বললাম, আপনারা যদি বিশ্বাস রাখেন, আমি নূরীর সঙ্গে যেতে রাজি আছি। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সেদিন আমি নিজেই নূরীকে চট্টগ্রাম নিয়োগ পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেলাম। ঠিক আটদিন পর, পত্রিকা হাতে নূরীর চোখে মুখে খুশির ঢেউ। সে তো আনন্দে আটখানা হয়ে পড়ছে। তখন আমি অফিসে ছিলাম। হেন্ডসেটে নূরীর কল, রিসিভ করতেই নূরী বলে উঠল গরম খবর। আমি বললাম : এমন কি গরম খবর? সে বলল: (প্রা:) বিদ্যালয়ে আমার চাকরিটা হয়েছে। দেখেন দেখেন পত্রিকায় আমার রোল এসেছে! সত্যি বলছ নাকি? নূরী বলল: হঁ্যা আপনি নেটে দেখেন। আমি নেট খুলে দেখি আদো সত্যি! নূরী, তুমি সব প্রচেষ্টাই সফল। অফিস শেষে বিকেলে মিষ্টি নিয়ে গেলাম নূরীর বাসাই। তাকে বললাম: তোমার ভেতরে মেধা ও মনন সবই লুকিয়ে আছে। লক্ষ্যবস্তু ঠিক থাকলে জীবনের সব স্বপ্নই সফল হবে! লক্ষ্য করলাম নূরীর চোখে জল পড়ছে। জল মুচে দিয়ে বললাম: নূরী তুমি কাঁদছ কেন? নূরী আমায় জড়িয়ে ধরে বলল: আজতো সুখের কান্নাই কাঁদছি। সে বলল: আমি এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না। আপনার সহযোগিতার জন্যই আমি আজ এতটুকু আসতে পেরেছি। না না নূরী সহযোগিতা করেছি সত্য, তবে তোমার কোনো পরীক্ষার খাতায়তো আমি লিখে দিয়ে আসিনি। তোমার সব ক্লাসে ভালো ফলাফল করার এবং নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সম্পূর্ণ কৃতিত্বই তোমার। নূরী যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করল, আমার হৃদয়ে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি সৃষ্টি হলো। আর সেই জলরাশির সৈকতে এসে ঠাঁই নিল নূরী। আমার হৃদয়ের আঙ্গিনা নূরীর অস্তিত্ব অনুভব হতে লাগল। নূরীর রূপ অতো সুন্দর নয়, তবে তার নম্র কথাবার্তা মেধা ও মননের অপার সম্ভাবনা এবং তার মধ্যে বিরাজমান গুণই আমাকে অভিভূত করেছে। আমি জানি আমার প্রস্তাবে নূরীর বাবা-মা 'না' উচ্চারণ করবে না। কিন্তু নূরীর মতামত নেয়াতো জরুরি। কারণ, সে অন্য কাউকে তো ভালোবাসতে পারে। একদিন নূরীকে হেন্ডসেটে বললাম: নূরী আজ বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে এসো, কথা আছে। এর একটু পূর্বে জানতে পারলাম দু'জনের অভিভাবক চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, আমাদের উভয়ের ব্যাপারে। সেদিন লাইব্রেরিতে বসে আমি আর নূরী কবি জীবনান্দ দাসের লিখা বনলতার সেন ও রূপসী বাংলা পড়ছিলাম। এ সময় নূরীর পড়ালেখা কেমন চলছে জানার পর তাকে বললাম: নূরী আজ এখানে আসছি একটা অফার নিয়ে। তুমি প্রতিজ্ঞা কর কাউকে বলবে না, হঁ্যা। প্রতিজ্ঞতা করলাম। নূরী যেদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা সে থেকে তোমাকে আমার বুকে লালন করি। তোমাকে বলার সুযোগ হয়নি বা সাহস করিনি। অফারটা হলো এই যে, আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাকে আমার জীবন সঙ্গিনী করে রাখতে চাই। এই সিদ্ধান্তে তুমি রাজি কি না, চিন্তা করে 'হঁ্যা' বা 'না' আমাকে জানাবে। নূরী শির নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল: স্যার: আপনি আমার জন্য যা-ই করেছেন, এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না ! তা ছাড়া আপনার মতো আরেকজন লোক সারা জীবন খুঁজেও পাব না! আপনাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। অর্থাৎ আজ থেকে পৃথিবীটা আমার। আর এই সুবর্ণ সুযোগ কে বা হারাতে চায়? বলুন, তা তো না। আমি দীর্ঘদিন তোমার প্রতিক্ষায় ছিলাম। স্বপ্নতো সত্যিই হলো এবং সেই প্রতিক্ষার অবসান। পিস্নজ একটা কথা বলি? হঁ্যা নূরী বল, আজ থেকে আমি আপনার। কিন্তু বাবা-মা তো এ বিষয়ে পাকা কথা বলেছে। তুমি কিভাবে জানলে? নূরী বলল: ছোট বোনের কাছে শুনলাম। তবে আপনি তো একটা গ্রম্নপের বিপণন কর্মকর্তা, তীক্ষ্ন বিচক্ষণ। আপনি কিভাবে আমাকে নিয়ে ভাবলেন? না না নূরী নিজেকে এত ছোট ভেব না। যদিও জানতাম আপনি বড় মাপের মানুষ তবে, চিরদিন বুকে আগলে রাখবেন আশা করিনি। আপনার স্নেহে এসে ধন্য হলাম, প্রশান্তি পেলাম!