বিলকিছ

প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। বিলকিছ আমার ক্লাসমেট। ফুরফুরে, চঞ্চল স্বভাবের একটি মেয়ে। পাখির মতো ডানাওয়ালা লাল ফ্রক পরে বিলকিছ সেদিন স্কুলে এসেছিল। টিফিন পিরিয়ডে সবাই চেরা (মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ভাঙা অংশ) খেলছিলাম। তখনকার দিনে চেরা খেলা ছিল প্রাণের খেলা। উচ্ছ্বাসের খেলা। দীর্ঘক্ষণ দৌড়ানোর ফলে ঘেমে অস্থির। এমন সময় বিলকিছ আমার হাত থেকে চেরাগুলি ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। আমি উচ্চস্বরে কান্না করতে লাগলাম 'এই তুই আমার চেরা নিলে ক্যান? তুই কি আমার বউ লাগস। আমি কেন তাকে বউ বললাম, এতে সে ভীষণ রকম ক্ষেপে গেল। রাগে তার দুচোখ লাল বর্ণ ধারণ করল। বিলকিছ আমাকে উদ্দেশ করে বলল, 'দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি মজা।' আমি থ' খেয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম অশুভ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমার ঘামের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। শরীর ভিজছে- কিন্তু অন্তর ভয়ে শুকিয়ে বড় বড় ফাঁটল ধরতে শুরু করছে। আমি কি বলব বা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মৌলভী স্যার, যে স্যারের ধমকে আমরা প্যান্টও ভিজিয়ে ফেলতাম। সেই মৌলভী স্যারের কাছে কান্না ভেজা চোখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নালিশ জানানো হলো 'আলিম বলেছে, সে আমাকে বিয়ে করবে। মৌলভী স্যার চোখের চশমাটি কপালে উঠিয়ে বলল, তাই নাকি? সঙ্গে থাকা ডানপিটে ছেলেগুলো সমস্বরে বলে উঠল, জি স্যার, ও ঠিকই বলেছে। আমরা নিজের কানে শুনেছি। স্যার এবার অর্ডার দিলেন, আলিমকে ধরে নিয়ে আয়। আমি লুকিয়ে সব কথা শুনছিলাম। স্যারের শেষ কথা শেষ হতে না হতেই স্কুলের পূর্বদিকে পতিত ক্ষেত বরাবর দিলাম ভোঁ-দৌড়। এদিকে স্যারের অর্ডার কে আগে পালন করতে পারে শুরু হলো এই প্রতিযোগিতা। কয়েকজন ডান পিটে ছেলে আমার পিছু ধাওয়া করছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ মাটির টিলায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম আর এই সুযোগে সবাই আমাকে ধরে ফেলল। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, দোস্ত আমাকে ছেড়ে দে। স্যার ভীষণ মারা মারবে। পাশ থেকে রায়হান বলল, না, স্যার বলেছে তুর বিয়ে হবে আর আমরা পোলাওয়ের দাওয়াত খাব। এই প্রথম কোনো মেয়ের অভিযোগের জালে আমি ধরা খেলাম। নত মস্তকে স্যারের সামনে আমি এক আসামি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। বিলকিছকে ডেকে আনা হলো। স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বিচার দেখার জন্য। স্যার বিলকিছকে উদ্দেশ করে বলল, তোকে সে বিয়ে করতে চায় কিন্তু সে-ই তো থাকে ভাঙ্গা ঘরে চৌকির নিচে আবার তোকে বিয়ে করে জায়গা দেবে কোথায়? স্যারের এই কথা শুনে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল। এবার স্যার চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রে বালায়েক, যা ওর কাছে সরি বল। সেদিন এত্তএত্ত ছাত্রছাত্রীর সামনে স্যার আমাকে একশ বেতের আঘাত করলে যে লজ্জাটুকু আমি পেতাম তার চেয়েও বেশি লজ্জা পেয়েছিলাম দু'বর্ণের একটি শব্দ 'সরি' বলতে গিয়ে। সময়ের আবর্তে সেই বিলকিছ আজ আমার জীবনসঙ্গিনী। বিলকিছ খাটের বামপাশটায় হেলান দিয়ে আমাদের চারচোখের মনি একমাত্র শিশু ৬ মাস বয়স্ক রাজকে খাওয়াচ্ছে। আমি পাশে বসে ইকবাল খন্দকারের 'গুদাম ভরা হাসি' পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার অট্ট হাসিতে বিলকিছ ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে বলল, গুদাম ভরা হাসি কি গুদাম উপছে পড়ছে? আমি হাসির রাশ টেনে বললাম, না হাসছি অন্য কারণে। বিলকিছ বলল, অন্য কারণে? আমি বললাম, সেই পঞ্চম শ্রেণির ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। বিলকিছ এবার একগাল হেসে বলল, তুমি এক ঘটনা আর কত দিন মনে রাখবে। আমি বললাম, কিছু ঘটনা ভুলে যেতে নেই। তাহলে স্মৃতির ভান্ডারে জমা থাকবে কী? সদস্য, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম ময়মনসিংহ