রঙ চা

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মোফাজ্জল হোসেন জামান
এই বৃষ্টির দিনে। বাসন্তির সকালে। আকাশের ডাক শোনে ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে জেগে দেখি অঝর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি। আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম বেলকনির দিকে। আমার দৃষ্টি বাহিরে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে ডাক শোনা যাচ্ছে বোনের। বলছে, জামান ভাই, এই নাও তোমার রঙ চা। আমি পেছনে না তাকিয়েই বললাম, 'ইতি' চায়ের কাপটা কাঠের চেয়ারে রেখে যা। ইতি আমার খালামনির মেয়ে। সেই সূত্রে ইতি আমার কাজিন। বয়সে আমরা একই সমান। তাই, ইতিকে আমি কখনো তুই, কখনো তুমি, কখনো আপনি বলে ডাকি। মন যা বলে, তখন তাই ডাকি। ইতির পুরু নাম 'আছিয়া ছিদ্দিকা ইতি'। আমি ইতিকে ভালোবেসে আছিয়া বলে ডাকি। কিছু দিন পর পর আছিয়া আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। যত দিন আমাদের বাড়িতে থাকে তত দিন আছিয়ার নিজের হাতে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ বার আমাকে রঙ চা বানিয়ে খাওয়াবে। আছিয়া জানে আমি রঙ চা পছন্দ করি। আছিয়া চা বানাতে পারে খুব ভালো, এটা আমাদের বাড়ির সবাই জানে। তাই, আছিয়া আমাদের বাড়িতে এলে চা বানানোর দায়িত্বটা বরাবরই আছিয়ার ওপর দেয়া হয়। আছিয়ার হাতে বানানো রঙ চা আমারও খুব প্রিয়। জানিনা, আমাদের দুজনের মধ্যে রসায়নের কি আকর্ষণ! মনে মনে চিন্তা করি, হয়তো এই আকর্ষণটা আবেগ, নয়তো গভীর ভালোবাসা। কথাগুলো ভাবতে ভাবেত আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম অচেনা কোনো এক দেশে। যেখানে আমি আর আছিয়া ছাড়া কোনো মানুষ বসবাস করে না, শুধু আমি আর আছিয়াই সেই দেশের বাসিন্দার। হঠাৎ পেছন থেকে আছিয়ার ডাক! জামান ভাই তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। আছিয়ার নরম গলায় মিষ্টি সুরের কণ্ঠটা শোনে আমি দ্বিতীয়বারের মতো হৃদয়ের মধ্যে একটা ভালোবাসার ধাক্কা খেলাম। খানিক সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া সেই অচেনা ভালোবাসার শহর থেকে ফিরে এলাম। আমি স্বাভাবিক হয়ে আছিয়াকে বললাম খাচ্ছি- তুই যা। এই কথা শোনে আছিয়া পাশের রুমে চলে গেল। তারপর আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক করে চা খেতে থাকলাম। আর আছিয়ার ভালোবাসার স্বাদ নিতে লাগলাম। আর বেলকনির ভেতর দিয়ে বৃষ্টি এসে আমাকে স্পর্শ করছে। আমি আরও দুর্বল হয়ে পড়লাম আছিয়ার প্রতি! বৃষ্টির সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। বৃষ্টি এলে আমি সারাক্ষণ বেলকনিতে বসে বৃষ্টির সঙ্গে আমার ভালোবাসার কথা বলি, আছিয়ার রূপের কথা বলি, আছিয়া আর আমার স্বপ্নের কথা বলি। হঠাৎ আমার চোখ চলে যায় বেলকনির ভেতর দিয়ে দূর সেই ঘন সবুজের মাঠে। বৃষ্টি পড়ছে তবুও কৃষান-কৃষানিরা কাজ করছে। মাঝে মাঝে ভাটিয়ালির গান ভেসে আচ্ছে কৃষান-কৃষানির কণ্ঠে। গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে আরও সবুজ হয়ে যাচ্ছে এবং আমার বাংলা মায়ের রূপটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বৃষ্টি নেমেই চলছে। বৃষ্টির কোনো ক্লান্তি নেই! এই বৃষ্টির মধ্যেই আকাশের ওপর দিয়ে কতগুলো পাখি উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দুটি পাখি আমার বেলকনির সামনে কামিনি ফুলের গাছে ছোট্ট একটি ডালে এসে বসল। মাথায় ঝুঁটিবাঁধা। আমাদের কিশোরগঞ্জ জেলা, কটিয়াদী উপজেলার ভাষায় ময়না পাখি বলে ডাকি। অনেক দিন পরে ময়না পাখি দেখলাম! এখন আর আগের মতো পাখি দেখা যায় না! কারণ, পাখি শিকারি পাখি মেরে ফেলছে, দিন দিন ফসলি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে চলছে। তাই, আসতে আস্তে আমাদের গ্রাম থেকে পাখিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! আমি নাছোর বান্দার মতো পাখি দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বৃষ্টি পড়ছে আর পড়ছে। পাখি দুটি আপন মনে ভালোবাসার গল্প করছে। আমি আবার, রসায়নের টানে হারিয়ে গেলাম আছিয়ার ভালোবাসার শহরে। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম। আজ যদি এই বৃষ্টির দিনে আমিও পাখি দুটির মতো আছিয়াকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গল্প করতে পারতাম। এই পাখিগুলোর মতো আমিও আছিয়ার সঙ্গে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। এই কথাগুলো ভাবলেই কেমন জানি যৌবনের সাগরে উত্তাল-পাতাল ঢেউ উঠে! সেই ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি যে কোথায় হারিয়ে যাই বোঝতেই পারিনি! তাও বোঝতে পারিনি আছিয়া আমার পাশে কখন যে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ চায়ের কাপটার ওপর নজর গেল। রঙ চায়ের কাপটা কখন যে, বৃষ্টির পানি এসে সাদা জলের রূপান্তর করল, বোঝতেই পারিনি! তারপর, নিজেকে স্বাভাবিক করে আছিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই কখন এলি আছিয়া? আছিয়ার মধুমাখা গলায় বলল, অনেকক্ষণ হলো এলাম। আর তোর চা খাওয়া দেখছিলাম। হঠাৎ আছিয়া বলল, জামান ভাই তোর জন্য আর একটা রঙ চা বানিয়ে আনবো? আমি বললাম, আনলে ভালোই হবে। এতক্ষণে বৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে। আমিও বৃষ্টি ভেজা জামাটা চেঞ্জ করে আবার চলে গেলাম বেলকনিতে। তারপর, আছিয়াও চা নিয়ে হাজির হয়ে গেল বেলকনিতে। আমাকে এক কাপ চা দিয়ে আছিয়ার জন্যও এক কাপ চা নিয়ে এলো। আছিয়া আর আমি দুজনেই চোখে চোখ রেখে চা খাচ্ছি। আর আমার ভালোবাসার কথাগুলো আছিয়াকে বলতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে পাশের রুম থেকে ভেসে আচ্ছে 'বাবার' ডাক। জামান বৃষ্টি কমে গেছে। আজ তোর টিউশনি নেই, কম্পিউটার সেন্টারে যাবে না? আমি উত্তরে বললাম, যাবো বাবা এই তো এখনই চলে যাচ্ছি। আমার ভালোবাসার কথাগুলো আমার বুকের মধ্যেই জমা রেখে, আমি আছিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারপর, প্রতিদিনের মতো ঘর থেকে বাহির হয়ে গেলাম টিউশনি করার জন্য এবং ফ্রেন্ডস কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্লাস নেয়ার জন্য...... কটিয়াদী কিশোরগঞ্জ।