ট্রেন এবং চশমা

প্রকাশ | ১৪ মে ২০১৯, ০০:০০

ফজলে এলাহী
অফিসের গাড়িতে লেট, কখনো লোকাল বাসে ঝুলে- রাস্তায় ২-৩ ঘণ্টা জ্যাম হজম করে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতে প্রায়ই কষ্ট হতো। আমার বাসা থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন কাছেই। কতদিন আক্ষেপের সুরে বলেছি, যদি ট্রেনে যাতায়াত করতে পারতাম! তাহলে জ্যাম থাকত না। প্রায়ই শুনতাম ৯টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে, এটা ভেবে পিছু হটেছি অনেকদিন। এরই মধ্যে রাজপথে নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে রাস্তা একেবারেই বন্ধ থাকে। সিদ্ধান্ত নিলাম একবার ট্রেনে চড়েই দেখি না- কি হয়। প্রথমেই লোকাল ট্রেনের শিডিউল নিলাম, যা অফিসগামী যাত্রীদের জন্য ভালো। তবে এত ভিড় যে, লোকাল ট্রেনে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠা খুবই মুশকিল। আবার আন্তঃনগর ট্রেনে ভাড়া বেশি বিধায় উঠতাম না। এভাবে ১০-১৫ দিন চলার পর হঠাৎ একদিন টিটি টিকেট চেক করতে এলে পাশে অনেকেই বলল মান্থলি টিকেট। আমি টিকেট দেখালাম। এরপর পাশের ভদ্র লোকটিকে বললাম মান্থলি টিকেট কি, এটা কিভাবে কাটতে হয়। তিনি বললেন, মাত্র ৪৫০ টাকায় আপনি সারা মাস যত খুশি যেতে পারবেন গাজীপুর পর্যন্ত। একটা দরখাস্ত ও এককপি ছবিসহ ১-১০ তারিখের মধ্যে টাকা জমা দেবেন। সেই থেকে শুরু। এখন আর লোকাল ট্রেনে উঠি না। বিপদে পড়লে উঠি। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি একদিন আন্তঃনগর ট্রেন শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিলে অগত্যা লোকাল ট্রেন তুরাগে উঠার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা শুরু। আমার মতো মতিঝিলে ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনেক ধাক্কা সয়ে কোনোমতে ট্রেনে উঠলাম। উঠে এককোণে দাঁড়াতেই ঘটলো বিপত্তি। থ্রি পিস পরিহিত এক মহিলা আমাকে বলল, আপনি আমার চশমা ভেঙেছেন কেন? আমি দেখলাম হঁ্যা চশমাটা ভাঙা দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, বললাম, ট্রেনে উঠার সময় আমার সামনেতো কোনো মহিলা ছিল না। আমি কিভাবে ভাঙব। অন্যান্য যাত্রীরা আমাদের কথাগুলো শুনছেন। মহিলা বললেন, আমি পেছনে ছিলাম আপনার সঙ্গেই ধাক্কা লেগে চশমা ভেঙেছে। খুব বিপদে পড়লাম, অন্যান্য যাত্রীরা বলল, ভাই লোকাল ট্রেন তার ওপর আজকে ভিড় বেশি, এমনটা হতেই পারে। আমি বললাম, আপা আমার কাছে অত টাকাও নেই যে আপনাকে চশমা কেনার দাম দেব। মহিলা বলল, এটা খুব দামি চশমা সবখানে পাওয়া যায় না। আর আমার স্ট্যাটাস আপনি জানেন? ধমক দিয়েই কান্না শুরু করলেন, কাঁপছেন। আমি তো আরো ভয় পাচ্ছি, কি জানি হয়। আমিসহ অন্য যাত্রীরা বলল, আপা আপনি কাঁদছেন কেন? মহিলা বলল, আজকে আমার ৪-৫টি সিজার অপারেশন করার কথা। চশমা ছাড়া আমি একদমই অচল। জানা গেল, তিনি সরকারি হাসপাতালের গাইনি ডাক্তার। উনি মোবাইলে কোনো এক সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে আজকের অপারেশনের দায়িত্ব নিতে বলেন। এ বলে আবারও কান্না শুরু করলেন এবং বললেন, সামনের স্টেশন ক্যান্টনমেন্ট না ভাই, আমাকে একটু নামিয়ে দেবেন, বাসায় ফিরে যাব। ক্যান্টেনমেন্ট স্টেশন- নিশ্চয় চোখে ঝাপসা দেখছে ভেবে বললাম আপা আপনাকে হেল্প করব? গাড়িতে উঠিয়ে দেব? উনি বললেন, না আমি একাই যেতে পারব, কাউকে ফোন করে আসতে বলব। তারপর অনেক খুঁজেছি, কথা বলব বলে, পেয়েও গেছি, এখন প্রায়ই দেখি তবে উনি যে বগিতে উঠেন, আমি সে বগিতে উঠি না। মনে হয় সেদিন স্পষ্ট না দেখার কারণে চিনতে পারে না। তবে তাকে দেখলেই মনে পড়ে চশমার গুরুত্ব এবং ঘটনাটি।